চাপড়ার আলফা পঞ্চায়েতের সদস্য সাহাজাদ্দিন মণ্ডলের বাড়ি। তালিকায় নাম রয়েছে তাঁর স্ত্রী লক্ষ্মী মণ্ডলের। ছবি: প্রণব দেবনাথ
কথা ছিল, সংখ্যালঘু অসহায় দুঃস্থ মহিলারা পাবেন ঘর। কিন্তু তালিকায় তার বদলে কোথাও রয়েছে তিনতলা বাড়ির মালিক তৃণমূল পঞ্চায়েত সদস্যের বিবাহিত মেয়ের নাম, আবার কোথাও তৃণমূলের দু’বারের পঞ্চায়েত সদস্যের স্ত্রীর নাম, কোথাও পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষের স্ত্রীর নাম।
চাপড়ার বিধায়ক ও পঞ্চায়েত সমিতির সভানেত্রীর তরফে ব্লক অফিসে জমা পড়েছে এই তালিকা। তবে গোলমালের আঁচ পেয়ে তালিকা খতিয়ে দেখে অযোগ্যদের নাম বাদ দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। তবে তৃণমূলের একাংশের ধারণা, দুই গোষ্ঠীর রেষারেষির কারণেই বিষয়টি সামনে আসতে শুরু করেছে।
রাজ্য সরকারের সংখ্যালঘু কল্যাণ ও মাদ্রাসা শিক্ষা দফতরের ‘ডেস্টিটিউট মাইনরিটি উইমেন্স রিহ্যাবিলিটেশন প্রোগ্রাম’-এর মাধ্যমে সহায়সম্বলহীন সংখ্যালঘু মহিলাদের ঘর দেওয়া হয়। তিনি বিধবা হতে পারেন, স্বামী-বিচ্ছিন্না হতে পারেন, আবার না-ও হতে পারেন। মোদ্দা কথা, মাথার উপরে পাকা ছাদ নেই এবং বাংসরিক আয় এক লক্ষ টাকার কম এমন মহিলারাই এই প্রকল্পে ঘর পাওয়ার যোগ্য। প্রকল্পে মোট ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকার অর্ধেক প্রথমে দেওয়া হয়। কাজ অর্ধেক সম্পন্ন হলে তবেই বাকি ৬০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। সমস্ত টাকাটাই দেওয়া হয় ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে।
নিয়ম অনুযায়ী, ব্লক প্রশাসন এই তালিকা তৈরি করে জেলা প্রশাসনের কাছে পাঠায়। ব্লক প্রশাসন সাধারণত এলাকার জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে নাম সংগ্রহ করে। প্রশাসন ও তৃণমূল সূত্রে জানা গিয়েছে, চাপড়ার ব্লকের ক্ষেত্রে তৃণমূল বিধায়ক রুকবানুর রহমান এবং পঞ্চায়েত সমিতির সভানেত্রী সাবিনা ইয়াসমিন মণ্ডল তালিকা তৈরি করেছেন। তাঁদের সই করা ২৭৩ জন মহিলার তালিকা এসে পৌঁছয় বিডিও-র কাছে।
কিন্তু ব্লকের কর্মীরা সেই তালিকা খতিয়ে দেখতেই ঝোলা থেকে বিড়াল বেরিয়ে পড়তে শুরু করে। সেই সুযোগে দলের ভিতরে বিধায়কের বিরোধীরাও তালিকার ভুল ধরতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। তখনই দেখা যায়, তালিকায় এমন অনেকের নাম আছে যারা শাসক দলের গ্রাম পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতির সদস্যের আত্মীয়, স্ত্রী, মেয়ে। তার বাইরেও অনেক নাম আছে যারা কোনও ভাবেই এই ঘর পাওয়ার যোগ্য নন। তালিকার অন্তত অর্ধেক নামই এমন বলে প্রশাসন সূত্রের খবর।
চাপড়ার আলফা গ্রাম পঞ্চায়েতের দু’বারের সদস্য সাহাজাদ্দিন মণ্ডলের বাড়ি পাথুরিয়া গ্রামে— ঝাঁ-চকচকে মোজাইক করা পাকা বাড়ি। তাঁর স্ত্রী লক্ষ্মী মণ্ডলের নাম আছে তালিকায়। শুক্রবার দুপুরে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সাহাজাদ্দিন দাবি করেন, “নেতারা বলল যে আমার নামে ঘরের টাকা আসবে। সেই টাকা বিলিয়ে দেওয়া হবে গ্রামের গরিব মানুষের মধ্যে। সেই জন্যই আমি রাজি হয়েছি।”
বানিয়াখড়ি গ্রামের মাসুরা মণ্ডল আলফা গ্রাম পঞ্চায়েতে তৃণমূলের সদস্য। বছরখানেক আগে তাঁর বড় মেয়ে হোসেনারা খাতুনের বিয়ে হয়ে গিয়েছে তেহট্টে। হোসেনারার নাম আছে তালিকায়। তিনতলা পেল্লায় বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে মাসুরা ব্যাখ্যা দেন, “আসলে আমরা এখন মেয়ে-জামাইকে নিজেদের কাছে রাখতে চাইছি। তাদের তো একটা ঘর করে দিতে হবে। সেই কারণেই সরকারি ঘরের টাকাটা পেতে চেয়েছিলাম।”
হাতিশালা ১ গ্রাম পঞ্চায়েতে মহেশনগর গ্রামে পঞ্চায়েত সমিতির স্বাস্থ্য কর্মাধ্যক্ষ আসফল বিশ্বাসের পাকা দালানকোঠা। তালিকায় নাম রয়েছে তাঁর স্ত্রী সুফিয়া বিশ্বাসের। প্রসঙ্গটা তুলতেই ভাবলেশহীন ভাবে আসফল বলেন, “গরিব মহিলারা তো ঘর পাচ্ছেই। তা বলে নিজেদের জন্য কিছু রাখব না, তা হয় নাকি?”
তৃণমূলেরই অনেকের দাবি, এই তালিকায় শুধু যে দলের লোকের নাম আছে তা নয়, কেবল বিধায়ক-ঘনিষ্ঠদের নামই রাখা হয়েছে। ব্লক সভাপতি জেবের শেখের ঘনিষ্ঠদের কারও নাম নেই। প্রত্যাশিত ভাবেই প্রশ্ন উঠছে, কী করে এমন তালিকা পাঠালেন বিধায়ক? রুকবানুরের দাবি, “আমি নিজে তো তালিকা করি না। দলের জনপ্রতিনিধিরা নামগুলো দেন। আমার পক্ষে সব নাম ধরে খতিয়ে দেখা সম্ভব নয়।” তার পরেই তাঁর সংযোজন, “আমি তো বলিনি যে তালিকায় নাম থাকা সবাইকেই ঘর দিতে হবে। বিডিও তালিকা খতিয়ে দেখে যাঁরা যোগ্য নন তাঁদের নাম বাদ দিয়ে দিন। আমিও সেটাই চাই।” আর পঞ্চায়েত সমিতির সভানেত্রী সমস্ত প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে বলেন, “আমার মেয়ে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে। তার চিকিৎসা নিয়ে আমি ব্যস্ত। এই বিষয়ে এখন কিছু বলতে পারছি না।”
বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পরে জেলাস্তর থেকেও তালিকায় থাকা প্রতিটি খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ব্লক প্রশাসনকে। তালিকা ধরে বাড়ি-বাড়ি যাচ্ছেন ব্লকের কর্মীরা। তাঁদেরই এক জনের কথায়, “যত দেখছি, ততই চমকে উঠছি। অর্ধেক মহিলাই বাড়ি পাওয়ার যোগ্য নন।” বিডিও অন্বেষকান্তি মান্না বলেন, “আমরা তালিকা ধরে খতিয়ে দেখছি। আমি ১০০ শতাংশ নিশ্চিত করে বলতে পারি যে এই প্রকল্পের জন্য অযোগ্য কোনও মহিলা বাড়ি তৈরির টাকা পাবেন না।”