Coronavirus in West Bengal

শিকড়ের টানে দূর থেকেই সাহায্য

গ্রামের বহু পরিবারের কাছেই এখন খাবার নেই। ফুরিয়েছে রেশনের খাবারও।

Advertisement

বিমান হাজরা

শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০২০ ০০:৪৮
Share:

ছবি: পিটিআই।

শিকড়ের টানেই ওঁরা ফের গ্রামের পাশে। পড়াশোনা, ভাল পেশার জন্য কেউ গ্রাম ছেড়েছেন ১০ বছর, কেউ তারও বেশি। গণ্ডগ্রাম ছেড়ে এখন কেউ থাকেন কলকাতায়, কেউ বহরমপুরে, কেউ বর্ধমানে। লকডাউনে ঘরবন্দি সকলেই। তবু এই দুঃসময়ে কেউই ভুললেন না গ্রামের কথা। সাগরদিঘির দামোশ বিলের জলাশয় বেষ্টিত প্রত্যন্ত গ্রাম উলাডাঙা। এখন যাঁরা গ্রাম ছেড়েছেন, তাঁদের শৈশব, কেটেছে এখানেই। পড়াশোনার শুরুও গ্রামের স্কুলেই।

Advertisement

শিকড়ের সেই টানেই ওঁদের ফোন এল ভাইরাস আতঙ্কের লকডাউনের দুঃসময়ে কেমন আছেন তাঁদের গ্রামের মানুষগুলো? সেই খোঁজ নিতে গিয়েই জানলেন গ্রামের বহু পরিবারের কাছেই এখন খাবার নেই। ফুরিয়েছে রেশনের খাবারও। কাজ নেই। বেসরকারি ত্রাণ অন্যত্র গেলেও প্রত্যন্ত উলাডাঙায় পা পড়েনি কারওরই।

সেই ভাবনা থেকেই তাঁদের উদ্যোগের শুরু।

Advertisement

গ্রামের সন্তান ওয়ালিউর রহমান কেন্দ্রীয় জিএসটি দফতরে কর্মরত। উলাডাঙা গ্রামে এখনও থাকেন তাঁর ভাইপো। সেখানকারই এক হাইস্কুলের ইংরেজির শিক্ষক। ৬০০ পরিবারের গ্রামকে ঘিরে রেখেছে দামোশের বিল। নৌকো পেরিয়ে যাতায়াতই ছিল এক সময়ের ভরসা। স্কুলে যাওয়ার পথে তিন তিনবার নৌকোডুবি হয়েও বেঁচে গিয়েছিলেন ওয়ালিউর।

তিনি বলেন, ‘‘ভাইপোর কাছেই প্রথম জানতে পারি, এই দুঃসময়ে ভাল নেই গ্রাম। গ্রামে গুটিকয় স্বচ্ছল পরিবার। বাকিরা মধ্যবিত্ত। তাদের হয়তো চলে যাবে হয়ত কোনও রকমে। কিন্তু কেমন আছে দিনমজুর গাফফার, কবিরুল, সুধাকর, কাশীনাথেরা? কারও সঙ্গে ডান্ডাগুলি খেলেছি। ভাইপোকেই বলি খোঁজ নে কেমন আছে ওরা, কী করে চলছে ওদের।”

তাঁর কথায়, তিনি সরাসরি গ্রামের সেই পরিচিত মানুষগুলোর পাশেই দাঁড়াতে চান। তাঁদেরই সরাসরি টাকা পাঠাবেন। কার কেমন অবস্থা বুঝে তিনি টাকা দেবেন।

বালিয়া হাইস্কুলের শিক্ষক আনোয়ারুল হক বলছেন, “কাকার কথা শুনে গ্রামেই কয়েকজনকে নিয়ে বসলাম রবিবার। প্রবীণ শিক্ষক প্রভাত ঘোষকে সামনে রেখে কমিটি গড়ে শুরু হল কারা সব থেকে দুঃস্থ, তাঁদের নাম বাছাই করার কাজ। দু’দিন গ্রামে ঘুরে তৈরি হল তালিকা। দেখা গেল, সঙ্কটে রয়েছে ৬৯টি পরিবারের ৩০৬ জন সদস্য। এক মাসের জন্য আপাতত খাবার চায় তাঁদের।”

প্রস্তাব শুনেই গ্রামেরই বেশ কয়েকটি স্বচ্ছল পরিবার এগিয়ে এলেন। প্রদীপ রায়, কমিরুল শেখ, হোমিয়ো চিকিৎসক হামিদুল হক সহ কেউ দিলেন ১০ বস্তা চাল, কেউ ৪ বস্তা, কেউ ১২ বস্তা, কেউ নগদ টাকা। তালিকা তৈরি হল গ্রামের কে কোথায় আছেন বাইরে।

ফোন করতেই হাত বাড়ালেন বর্ধমানে কর্মরত শিক্ষক সাহাদাত হোসেন, উচ্চ মাধ্যমিক কাউন্সিলের ডেপুটি সেক্রেটারি ইয়াসার আরাফত, পুলিশের এএসআই খাইরুল শেখ, অবসর প্রাপ্ত কেন্দ্রীয় রাজস্ব দফতরের কর্মী মইজুর রহমান। কেউ দিলেন ১০ হাজার, কেউ ১২ হাজার, কেউ ৭০০০, কেউ ৫০০০।

ইয়াসার আরাফত বলছেন, “গ্রামেই জন্মেছি, হেসে খেলে শৈশব কাটিয়েছি। এই দুঃস্থ পরিবারের কেউ না কেউ ছিলেন আমারই সহপাঠী। চাকরি সূত্রে গ্রাম ছেড়ে এলেও জন্মভিটেকে ভুলি কী করে? বিপদের সময় এই সব উদ্যোগই তো ভরসা। তাই প্রস্তাব পেতেই সঙ্গে সঙ্গে সম্মতি দিয়েছিলাম। কিন্তু বিপদটা বড় গভীর। ওদের বলেছি গ্রামের প্রয়োজনে আমরা পাশে আছি সব সময়।”

সবার দেওয়া সাহায্যে কেনা চাল, আলু, ডাল, সরষের তেল, সাবান বৃহস্পতিবার পৌঁছে দেওয়া হল বাড়ি বাড়ি এক মাসের জন্য। জনপ্রতি ৪ কিলো চাল, ২ কিলো আলু।

সাহায্য পেয়ে দিনমজুর গাফফার বলছেন, “৮ জনের বিরাট পরিবার। রেশনে যা পেয়েছিলাম তা শেষ। গ্রামের ছেলেরা ৩২ কিলো চাল, ১৬ কিলো আলু, সরষের তেল, ডাল দিয়ে গিয়েছে। আপাতত কিছু দিনের জন্য স্বস্তি তো বটেই। এই দুঃসময়ে এটাই অনেক কিছু।”

কবিরুল বাড়িতে ছিলেন না। স্ত্রী রাহিনা বিবি বলছেন, “৬ জনের পরিবার একা মানুষটার দিনমজুরির উপর নির্ভর। কেউ যে এ ভাবে পাশে এসে দাঁড়াবে ভাবতে পারিনি। বুকে কিছুটা বল তো পেলাম।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement