ফাইল চিত্র
কলকাতায় পৌঁছে করোনা কাঁপিয়ে দিল কৃষ্ণনগরকেও। বিলেত থেকে আসা যে তরুণ দু’দিন বাইরে থাকার পরে মঙ্গলবার কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ে বেলেঘাটা আইডি-তে ভর্তি হয়েছেন, তাঁর শিশু চিকিৎসক বাবাই রয়েছেন এই কাঁপুনির কেন্দ্রে।
কৃষ্ণনগর পুরসভার সঙ্গে যুক্ত ওই শিশু চিকিৎসক এবং তাঁর গাড়ির চালককে মঙ্গলবার রাতেই বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু রবিবার কলকাতার ফ্ল্যাটে ছেলের সঙ্গে দেখার করে আসার পরে গত দু’দিন ওই চিকিৎসক দিব্যি অফিস করেছেন, চেম্বারে রোগী দেখেছেন, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডাও দিয়েছেন। রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ স্বাস্থ্যকর্তারা জেলা প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করে দু’জনকেই আইডি-তে পাঠাতে বলেন। রাত ১টা নাগাদ অ্যাম্বুল্যান্সে তাঁদের রওনা করানো হয়।
গত দু’দিন যাঁরা ওই চিকিৎসকের সংস্পর্শে এসেছিলেন, খবর শুনে তাঁরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানানো হয়েছে, যাঁদের সঙ্গে তিনি বৈঠক করেছিলেন, তাঁদের হোম কোয়রান্টিনে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসন সূত্রের খবর, এক বড়কর্তার অফিসেও গিয়েছিলেন ওই চিকিৎসক। তাঁকেও নজরে রাখা হচ্ছে। ওই দু’দিনে শিশুদের নিয়ে যাঁরা ওই চিকিৎসকের চেম্বারে গিয়েছিলেন, তাঁদের চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে। চালকের সংস্পর্শে যাঁরা গিয়েছেন তাঁদেরও চিহ্নিত করা হচ্ছে। তালিকা তৈরির জন্য উচ্চ পর্যায়ের দল তৈরি করা হয়েছে। অতিরিক্ত জেলাশাসক (স্বাস্থ্য), মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক, অতিরিক্ত মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারির (দ্বিতীয়), ওসি হেল্থ প্রমুখ ওই দলে আছেন। শ্যামলবাবু বা বিপ্লবের লালা পরীক্ষায় ভাইরাসের অস্তিত্বের প্রমাণ মিললেই তালিকাভুক্তদের হোম কোয়রান্টিন থেকে আইসোলেশন ওয়ার্ডে পাঠানো হবে। তবে সন্ধ্যায় বেলেঘাটা আইডি সূত্রে জানা যায়, দু’জনের কারও লালাতেই ভাইরাসের নিশ্চিত প্রমাণ মেলেনি। তাতে খানিকটা হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে জেলা প্রশাসন।
জেলা প্রশাসনের এক কর্তার দাবি, করোনা সংক্রান্ত নির্দেশিকা অনুযায়ী ওই চিকিৎসকের ‘সেল্ফ আইসোলেশন’-এ চলে যাওয়া উচিত ছিল। তিনি তা না করে সকলের মধ্যে থেকেছেন, এমনকি শিশুদের চিকিৎসা করেছেন। কৃষ্ণনগরের প্রাক্তন পুরপ্রধান তথা অন্যতম প্রশাসক অসীম সাহা বলেন, “ওই চিকিৎসকের সংস্পর্শে আসা সমস্ত কর্মীদের তাঁদের বাড়িতেই অন্তরীণ করা হয়েছে। পরবর্তী যা পদক্ষেপ করার স্বাস্থ্য দফতর করবে।”
পুরসভার যে কর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন ওই চিকিৎসক, তাঁদের এক জন বলেন, “কী ধরনের মানুষ বুঝুন! উনি বৈঠক করে আমাদের যে ধরনের সতর্কতামূলক পদক্ষেপ করার কথা বললেন, নিজে ঠিক তার উল্টো কাজটাই করছিলেন। আমাদের কথা নয় ছেড়েই দিন, আমাদের পরিবারের সদস্য বা বন্ধুবান্ধবদের কী হবে?”
গত দু’দিনে যে শিশুদের চিকিৎসা করেছিলেন ওই চিকিৎসক, তাঁদের বাড়ির লোকজনও আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। এ রকমই একটি শিশুর বয়স ছ’মাস, একই বাড়িতে প্রায় একই বয়সের তার জেঠার ছেলেও রয়েছে। ফলে সকলেই ভয় পেয়ে গিয়েছেন। শিশুটির জেঠার কথায়, “বাড়িতে দুটো শিশু। কী করব, বুঝে উঠতে পারছি না। এক জন চিকিৎসক হয়ে সব জেনেশুনে কী করে উনি এমনটা করলেন?”
কী করে এতটা অসাবধান হলেন এক জন চিকিৎসক?
ওই চিকিৎসকের গাড়ির চালক প্রথমে দাবি করেছিলেন, ডাক্তারবাবু বা তিনি কলকাতায় গেলেও ফ্ল্যাটে ঢোকেননি। যদিও জেলা স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে বলা হয়, বিমানবন্দরেই তিনি ছেলেকে আনতে গিয়েছিলেন। এ দিন সন্ধ্যায় বেলেঘাটার আইসোলেশন ওয়ার্ড থেকে ওই চিকিৎসক অবশ্য দাবি করেন, তিনি বিমানবন্দরে যাননি। কলকাতার ফ্ল্যাটে গিয়েছিলেন। তাঁর ছেলে মাস্ক পরে একটা ঘরে একাই ছিল। তিনি সেখানে ঢোকেননি।
ওই চিকিৎসকের দাবি, তখনও ছেলের শরীরে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ প্রকাশ পায়নি। তাই তিনি নিজেও পরে কোনও সাবধানতা অবলম্বন করেননি। যদি তা-ই হয়, কেন ছেলেকে ‘হোম আইসোলেশন’-এর মতো আলাদা ঘরে মাস্ক পরিয়ে রাখা হল, আর তিনি নিজেই বা কেন সেই ঘরে ঢুকলেন না? আর যদি বিন্দুমাত্র সন্দেহ হয়ে থাকে, চিকিৎসক হিসেবে কেন তিনি তৎক্ষণাৎ ছেলেকে আইডি-তে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করালেন না? ওই চিকিৎসকের যুক্তি, তখনও কিছু নিশ্চিত ভাবে জানা যায়নি, তাই ভর্তি করানো হয়নি।
চিকিৎসকের এই আচরণের জন্য ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন কি তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে? রাতে আইএমএ-র রাজ্য সম্পাদক শান্তনু সেন বলেন, ‘‘উনি যে চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়েছেন, বিশেষত এক জন চিকিৎসক হিসেবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। করোনা মোকাবিলা নিয়ে কাল আমাদের বড় বৈঠক আছে। সেখানেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’’