সত্যজিৎ বিশ্বাস। —ফাইল চিত্র।
বিশেষ আদালতে কৃষ্ণগঞ্জের তৃণমূল বিধায়ক সত্যজিৎ বিশ্বাস হত্যা মামলার বিচার যে এফআইআর-এর ভিত্তিতে হচ্ছে সেটি আসল এফআইআর নয়। বিধায়ক খুনের ঘটনায় অন্তত আরও দু’টি এফআইআর হয়েছিল, যেগুলি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে আদালতে আনা হয়নি। বিশেষ ভাবে তৈরি করা তৃতীয় একটি এফআইআর-এর ভিত্তিতে চলছে এই মামলা। মঙ্গলবার বিধাননগর ময়ূখভবনে বিশেষ আদালতের বিচারক জয়শঙ্কর রায়ের এজলাসে সওয়াল করতে গিয়ে এমনই দাবি করলেন অভিযুক্ত পক্ষের আইনজীবী সুবীর দেবনাথ।
আইনজীবীর বক্তব্য: সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ হল, কোথাও বড় অপরাধের খবর পাওয়া মাত্র পুলিশকে এফআইআর করে মামলা শুরু করতে হবে। তার আগে পুলিশ কোনও তদন্ত শুরুই করতে পারবে না। এফআইআর করার পর পুলিশ ঘটনাস্থলে যাবে। তা হলে আর খুশি মতো মামলা সাজানোর সুযোগ থাকবে না। কিন্তু এই মামলার তদন্তকারী অফিসার কৌশিক বসাক তাঁর সাক্ষ্যে বলেছেন, প্রত্যক্ষদর্শী প্রভাস মণ্ডল তাঁকে জানিয়েছিলেন যে ঘটনা ঘটার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তিনি থানায় ফোন করে খবর দেন। আর এক সাক্ষী রবি সাহাও আদালতে বলেছেন, ঘটনার কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রচুর পুলিশ নিয়ে হাঁসখালি থানার ওসি মাঠে উপস্থিত হয়েছিলেন। অর্থাৎ খুনের পরেই পুলিশ খবর পেয়েছিল। তা হলে ধরে নিতে হবে যে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মতো এফআইআর করে তবেই পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়েছিল। কিন্তু সেই এফআইআর আদালতে আনা হয়নি। কেন আনা হল না? তদন্তকারী অফিসারের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, পুলিশ প্রথম ফোন পাওয়ার পর কী কী করেছিল তার কোনও নথি তিনি আদালতে এনেছেন কি না। অফিসার বলেছিলেন, তিনি আনেননি। অর্থাৎ পুলিশ তথ্যগোপন করেছে বলে আইনজীবী দাবি করেন।
অভিযুক্ত পক্ষের আইনজীবী আরও বলেন: পুলিশ আদালতে যে এফআইআর পেশ করেছে সেটি খুনের দিন রাত ২টো ১৫ মিনিটে দায়ের করা হয়েছিল। তাতে অভিযোগকারী মিলন সাহা বলেছেন, চার জন লোক ছুটে আসে। তিন জন সত্যজিৎকে জাপটে ধরল। এক জন বলল, ‘গুলি কর’। তার পর গুলি চলল। অথচ এই এফআইআর পুলিশের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়নি। তাই তদন্তে নেমে পুলিশ ওই চার জনের মধ্যে দু’জনের নাম চার্জশিট থেকে বাদ দিয়েছে। যে দিন ওই দু’জনকে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে সে দিন মিলন সাহা আদালতে উপস্থিত ছিলেন এবং লিখিত ভাবে জানিয়েছিলেন যে ওই দু’জনকে ছেড়ে দেওয়ায় তাঁর আপত্তি নেই। অতএব ওই এফআইআর যে মিথ্যা ভাবে সাজানো হয়েছিল তা আর একবার প্রমাণ হয়ে গেল বলেও আইনজীবী দাবি করেন।
গ্রেফতার প্রসঙ্গে আইনজীবীর সওয়াল: সুজিত মণ্ডলকে পুলিশ এলাকা থেকে গ্রেফতার করেছিল ২০১৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি সকাল ৫.০৮ মিনিটে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মোতাবেক কাউকে গ্রেফতার করার সময় তার আত্মীয়-পরিজনদের কাউকে দিয়ে ‘অ্যারেস্ট মেমো’য় স্বাক্ষর করানো বাধ্যতামূলক। অথচ সুজিতের ‘অ্যারেস্ট মেমো’য় কারও স্বাক্ষর নেই। কেন নেই, তার ব্যাখ্যাও নেই। পুলিশ আদালতে জানিয়েছিল, অভিজিৎ পুন্ডারিকে গ্রেফতার করা হয় মেদিনীপুরের রাধামাধবপুর বাজার থেকে। তার ‘অ্যারেস্ট মেমো’তেও কারও স্বাক্ষর নেই। অন্য থানা এলাকা থেকে কাউকে গ্রেফতার করতে গেলে সংশ্লিষ্ট থানায় সাধারণ ডায়েরি করতে হয়, সেখানকার পুলিশ অফিসারের উপস্থিতির প্রমাণস্বরূপ স্বাক্ষর করাতে হয়। সে সবও কিছু নেই। আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে তদন্তকারী অফিসার তাপস ঘোষ জানিয়েছিলেন, অন্য এলাকা থেকে কাউকে গ্রেফতার করতে গেলে পুলিশ সুপারের অনুমোদন লাগে। যদিও সেই অনুমোদন তিনি দেখাতে পারেননি। অর্থাৎ মেদিনীপুর থেকে গ্রেফতারও ‘সাজানো গল্প’ বলে দাবি করেন আইনজীবী।
সওয়ালে আইনজীবী বলেন: তদন্তকারী জানিয়েছেন যে তিনি অভিজিৎকে গ্রেফতার করেছেন ২০১৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি। অথচ মামলার নথি বলছে, সিআইডি এই মামলার দায়িত্বভার নিয়ে ‘সিট’ গঠন করে ফেলেছে তার তিন দিন আগে, ১৫ ফেব্রুয়ারি। সে ক্ষেত্রে তাপস ঘোষ তো অভিজিৎকে গ্রেফতার করতেই পারেন না, কারণ মামলা তখন আর হাঁসখালি থানার হাতে নেই। তাপস ঘোষ আদালতে বলেছেন যে তিনি অভিজিৎকে মেদিনীপুর থেকে গ্রেফতার করে ১৮ ফেব্রুয়ারি রাতে হাঁসখালি থানায় ফেরেন। অথচ সিআইডি বলছে, তারা ১৮ ফেব্রুয়ারি রাতে অভিজিৎকে রানাঘাট থানা থেকে নিজেদের হেফাজতে নিয়েছে। একই লোক একই সময়ে দু’টি থানায় কী ভাবে থাকতে পারে?
মামলার পরবর্তী শুনানি ২৩ জুলাই।