—প্রতীকী চিত্র।
তাঁর নামে একটা সরকারি চাকরির চিঠি এসেছে! সপ্তাহদুয়েক আগে সামাদ শেখকে ফোন করে বলে ছিলেন তাঁর স্ত্রী। নদিয়ার নাকাশিপাড়ার হরনগরের বাসিন্দা তখন ডায়মন্ড হারবারে দর্জির কাজ করছিলেন। মধ্য চল্লিশের আবদুস সামাদ শেখের কথায়, “প্রথমে বিশ্বাসই হয়নি। এই মাঝবয়সে আবার কীসের সরকারি চাকরি? কবে লেখাপড়ার পাট চুকে গিয়েছে। কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।” শেষমেশ কাজে ছুটি নিয়ে বাড়ি এসে সামাদ জানতে পারেন তাঁকে চাকরির পরীক্ষা দিতে হবে। ১৪ বছর আগে দেওয়া এক চাকরির পরীক্ষার চূড়ান্ত পর্ব, যা এতদিন স্থগিত ছিল!
নবদ্বীপের বাবলারি পঞ্চায়েতের সামনে চায়ের দোকানদার মানব দত্তও একই ভাবে দিনকয়েক আগে জানতে পারেন তাঁর নামে চাকরির চিঠি এসেছে। আজ রবিবার, ১৪ বছর আগের এক চাকরির অসমাপ্ত পরীক্ষায় বসছেন মধ্য চল্লিশের মানব। পরীক্ষা দিচ্ছেন সোনা-রুপোর কারিগর রাজীব সরকার, ইলেকট্রিক সরঞ্জামের ব্যবসায়ী অগ্নীশ্বর ঘোষ কিংবা বেসরকারি কোম্পানির হিসাব রক্ষক সঞ্জয় অধিকারীর মতো অনেকে।
শুধু নদিয়ায় নয়। গোটা রাজ্যে এমন চিঠি প্রাপকের সংখ্যা ৭৩ হাজার ৯৭৮ জন। ১৪ বছর পরে কীসের পরীক্ষায় বসতে চলেছেন তাঁরা! জানা গিয়েছে বিষয়টি ২০১০ সালের। কথা ছিল মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশন গ্রুপ ‘ডি’ পর্যায়ে কয়েকশো শূন্যপদে লোক নিয়োগ করবে। সেই মত বিজ্ঞপ্তি জারি হয়। বলা হয়েছিল ‘প্রিলি’ এবং ‘মেইন’ দুই পর্বে পরীক্ষা হবে। তিন লক্ষের বেশি পরীক্ষার্থী ২০১০ সালের ২৮ নভেম্বর প্রাথমিক পর্বের পরীক্ষায় বসেছিলেন। তাঁদের মধ্যে ৭৩ হাজার ৯৭৮ জন চূড়ান্ত পর্বের যোগ্যতা অর্জন করেন। ২০১১ সালের ২৯ মে চূড়ান্ত পর্বের পরীক্ষার দিন ধার্য হয়। কিন্তু আইনি জটিলতায় সেই পরীক্ষা স্থগিত হয়ে যায়। জল গড়ায় কলকাতা হাইকোর্ট হয়ে সুপ্রিম কোর্টে।
দীর্ঘ আইনি লড়াই শেষে গত মে মাসে কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ পশ্চিমবঙ্গ মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশনকে ১০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ওই পরীক্ষা শেষ করার নির্দেশ দেয়। এরপরই তৎপরতা শুরু হয় ১৪ বছর আগের অসমাপ্ত সেই পরীক্ষা নেওয়ার। আজ ১ সেপ্টেম্বর, রাজ্য জুড়ে ওই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। কমিশন সূত্রে খবর, নদিয়া জেলায় মোট ৬২৭১ জনের এই পরীক্ষায় বসার কথা। জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক দিবেন্দ্যু পাল বলেন, “ আদালতের নির্দেশে এই পরীক্ষা হচ্ছে। জেলা সংখ্যালঘু দফতরের তত্ত্বাবধানে ও শিক্ষা দফতরের সহায়তায় পরীক্ষার ব্যবস্থা হয়েছে।”১৪ বছর পর পরীক্ষার ডাক পেয়ে পরীক্ষার্থীদের অনেকেরই আক্ষেপের শেষ নেই। সামাদ শেখ বলেন, “সেই সময় পুলিশ, সেনাবাহিনী, দমকল বিভিন্ন দফতরে পরীক্ষা দিতাম। এই পরীক্ষা অর্ধেক হয়ে আর হল না। অভাবের সংসারে কাজে লেগে গেলাম। ঠিক সময়ে পরীক্ষা হলে আজ হয়তো অন্য রকম জীবন হত।” ছোট্ট চায়ের গুমটির আয়ে নিজেরই ঠিক মত চলে না বলে বিয়ে করেননি মাধব। তাঁর কথায়, “বহুকাল পড়াশোনার সঙ্গে সম্পর্ক নেই। তবুও যাব পরীক্ষা দিতে।” একের পর এক চাকরির পরীক্ষা দিয়ে হতাশ সুজয় চন্দ এখন ব্যবসা করেন। তিনি বলেন, “এত দিনে বিষয়টাই ভুলে গিয়েছিলাম। চিঠি আসার পর জানতে পারলাম কোনও একটা চাকরির পরীক্ষায় অন্তত প্রাথমিক পর্বে পাশ করেছিলাম। যদি ঠিক সময়ে সব হত তাহলে হয়তো সব বদলে যেত।”রামচন্দ্র ১৪ বছর বনবাসে কাটিয়ে রাজ্য ফিরে পেয়েছিলেন। ১৪ বছর পর পরীক্ষা দিয়ে এঁদের কি চাকরির শিকে ছিঁড়বে?