West Bengal Panchayat Election 2023

পঞ্চায়েতে সংখ্যালঘু ও মতুয়া ভোটে নয়া অঙ্ক, চিন্তায় তৃণমূল, বিজেপি, ঘুরে দাঁড়াবে বাম-কংগ্রেস?

উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব প্রদানে দীর্ঘসূত্রিতার জেরে বিজেপি নেতৃত্বের উপর ‘ক্ষুব্ধ’ মতুয়াদের একটি বড় অংশ। অন্য দিকে, নদিয়া উত্তরের সংখ্যালঘু প্রধান এলাকায় ‘গোষ্ঠীকোন্দলের’ কারণে জেরবার শাসকদল

Advertisement

প্রণয় ঘোষ

কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ৩০ জুন ২০২৩ ২১:৪৭
Share:

—প্রতীকী চিত্র।

উত্তরে সংখ্যালঘু। আর দক্ষিণে মতুয়া। এই অঙ্কে ভর করেই বরাবর চালিত হয়ে এসেছে নদিয়ার ভোট-রাজনীতি। সাম্প্রতিক সময়ে দক্ষিণ নদিয়ায় যেমন বিজেপির একচ্ছত্র আধিপত্য দেখা গিয়েছে, তেমনই নদিয়া উত্তর কার্যত দখল করে রেখেছে শাসক তৃণমূল। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব প্রদানে দীর্ঘসূত্রিতার জেরে বিজেপি নেতৃত্বের উপর ‘ক্ষুব্ধ’ মতুয়াদের একটি বড় অংশ। অন্য দিকে, নদিয়া উত্তরের সংখ্যালঘু প্রধান এলাকায় ‘গোষ্ঠীকোন্দলের’ কারণে জেরবার শাসকদল। এই প্রেক্ষাপটে এ বারের পঞ্চায়েত ভোটে নয়া সমীকরণ দেখা গেলেও যেতে পারে বলে মনে করছেন জেলার রাজনৈতিক বৃত্তের একাংশ।

Advertisement

গত কয়েক বছরে দু’টি বড় ভোটে (লোকসভা এবং বিধানসভা) নদিয়া দক্ষিণে বিজেপির কাছে পিছু হটতে হয়েছে তৃণমূলকে। নাগরিকত্বের বিষয়কে সামনে রেখে মতুয়া-গড় নিরঙ্কুশ ভাবে নিজেদের দখলে রাখতে পেরেছে বিজেপি। কিন্তু পঞ্চায়েতের মতো একেবারে নিচু স্তরের ভোটে স্থানীয় সমস্যাগুলিই প্রধান হয়ে ওঠায় বিজেপির ‘নাগরিকত্ব-অস্ত্র’ খানিক ভোঁতা হয়ে গিয়েছে। মতুয়া প্রভাবিত শান্তিপুর, রানাঘাট, কল্যাণী (গ্রামীণ)-এ ধীরে ধীরে থাবা বসিয়েছে তৃণমূলের উদ্বাস্তু সেলও। ভোটবাক্সে তার প্রতিফলন দেখা গিয়েছে গত পুরভোটেও। এ ছাড়া নদিয়া দক্ষিণে গেরুয়া শিবিরের অভ্যন্তরীণ কোন্দল বাড়তি অক্সিজেন জুগিয়েছে শাসক শিবিরকে।

বৃহস্পতিবারই পঞ্চায়েত ভোটের প্রচারে রানাঘাটে গিয়েছিলেন বিজেপির সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি দিলীপ ঘোষ। তাঁর কর্মসূচিতে রানাঘাটের সাংসদ জগন্নাথ সরকার, রানাঘাট উত্তর-পূর্বের বিধায়ক অসীম বিশ্বাস, রানাঘাট উত্তর-পশ্চিমের বিধায়ক পার্থসারথি চট্টোপাধ্যায়েরা থাকলেও দেখা মেলেনি রানাঘাট দক্ষিণের বিধায়ক বিধায়ক মুকুটমণি অধিকারীর। যা নিয়ে দলের অন্দরেই জল্পনা তৈরি হয়েছে। বিজেপির একটি অংশের দাবি, ভোটের আগে থেকেই দলের অভ্যন্তরে দুই গোষ্ঠীর ‘ঠান্ডা লড়াই’ চলছিল। হতে পারে, সেই কারণে দিলীপের কর্মসূচিতে রানাঘাটের সাংসদ হাজির থাকলেও সেখানে হাজির ছিলেন না রানাঘাট দক্ষিণের বিধায়ক। তবে কয়েক দিন আগে কল্যাণীতে আয়োজিত বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর সভায় তাঁকে দেখা গিয়েছে। যদিও এই দাবিকে প্রকাশ্যে মানতে নারাজ দলীয় নেতৃত্ব। পার্থসারথির যুক্তি, ‘‘দিলীপবাবু মূলত রানাঘাট উত্তর-পশ্চিম বিধানসভা এলাকার কর্মসূচিতে এসেছিলেন। স্বাভাবিক ভাবেই দক্ষিণের বিধায়কের না থাকারই কথা।” জগন্নাথের সঙ্গে জেলা নেতৃত্বের ‘আড়াআড়ি সম্পর্ক’ নিয়েও দলের অন্দরে গুঞ্জন রয়েছে।

Advertisement

এই পরিস্থিতিতে নদিয়া দক্ষিণের হারানো জমি পুনরুদ্ধারে নেমেছে শাসকদল। জুন মাসেই দু’বার জেলা সফরে এসেছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। চলতি সপ্তাহে মতুয়া-গড় কৃষ্ণগঞ্জের বাদকুল্লায় সভাও করেছেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। মতুয়া এবং উদ্বাস্তু আবেগও উস্কে দেওয়ার চেষ্টা করেন অভিষেক। সিএএ-প্রসঙ্গ তুলে তিনি প্রশ্ন তোলেন, “যাঁরা নাগরিক, যাঁরা ভোট দিয়েছেন, তাঁদের আবার প্রমাণ দিতে হবে?” তাঁর দাবি, “আগে প্রধানমন্ত্রী ’৭২ সালের আগের কাগজ দেখান। ক্ষমতায় আছেন বলে হাতির পাঁচ পা দেখেননি!” এরই পাশাপাশি, কেন্দ্রীয় বঞ্চনার প্রসঙ্গ, বিজেপি জনপ্রতিনিধিদের কাজ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তৃণমূল সাংসদ। দলের উদ্বাস্তু শাখার প্রভাব বৃদ্ধি এবং শীর্ষ নেতৃত্বের বারবার আনাগোনায় পঞ্চায়েত ভোটে মতুয়া-গড়ে ভাল ফল হতে পারে বলেই মনে করছে শাসক শিবির। রানাঘাট সাংগঠনিক জেলা তৃণমূলের সভাপতি দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বিজেপির প্রতি মতুয়াদের মোহভঙ্গ হয়েছে। তাই এ বার তৃণমূল ভাল ফল করবে এখানে।’’ শাসক দলের এই দাবিকে বিজেপি অবশ্য গুরুত্ব দিতে নারাজ। দলের সাংসদ জগন্নাথ বলেন, ‘‘মতুয়া গড়ে হুল ফোটানোর ক্ষমতা নেই তৃণমূলের। আগের নির্বাচনগুলির থেকেও এ বার ভাল করবে বিজেপি। তৃণমূলের সংগঠন খাতায়কলমে থাকলেও বাস্তবে এর কোনও চিহ্ন নেই।’’

নদিয়া দক্ষিণকে এ বার পাখির চোখ করলেও, উত্তরে সংখ্যালঘু ভোটে ‘ভাঙন’ শাসকদলের শঙ্কা বাড়িয়েছে। দলের একাংশের মতে, এই ভাঙনের মূল কারণ গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। জেলার এক নেতার কথায়, ‘‘করিমপুর, চাপড়া, কালীগঞ্জ, পলাশীপাড়ার মতো সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জেরবার দল।’’ এই অবস্থায় স‌ংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় তৃণমূল থেকে বাম-কংগ্রেসে যোগদানের হিড়িকও দেখা গিয়েছে। পঞ্চায়েত ভোটে সংখ্যালঘু ভোট নিয়ে শাসক শিবির যে চিন্তায়, সে কথা কার্যত স্বীকার করে নিয়ে কৃষ্ণনগর সাংগঠনিক জেলা তৃণমূলের সভাপতি কল্লোল খাঁ বলেন, ‘‘সংখ্যালঘু এলাকায় দলীয় নেতাদের কোন্দল মিটিয়ে ফেলতে কড়া নির্দেশ দিয়েছে শীর্ষ নেতৃত্ব। যাঁরা ভুল বুঝে দল ছেড়েছেন, তাঁদের বুঝিয়েসুঝিয়ে আবার তৃণমূলে ফেরত আনতে হবে। বাম-কংগ্রেসের উত্থান চিন্তার তো বটেই!’’

২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে নদিয়াতে বাম-কংগ্রেস জোট ৪টি আসন পেয়েছিল। খালি হাতে ফিরেছিল বিজেপি। তবে তিন বছর পরের লোকসভা ভোটেই সেই ছবি অনেকটাই পাল্টে যায়। বাম ও কংগ্রেস আলাদা ভাবে লড়াই করে। কৃষ্ণনগর লোকসভা তৃণমূলের দখলে থাকলেও রানাঘাট লোকসভা ছিনিয়ে নেয় বিজেপি। সঙ্গে উপনির্বাচনে জেতে কৃষ্ণগঞ্জ। নদিয়ার দক্ষিণ প্রান্তের বিধানসভাগুলিতে ছিল বিজেপির দাপট। তৃণমূলের ভোট যতটা না কমেছে তার থেকেও বেশি কমেছে বাম ভোট। আর ততটাই শক্তি বৃদ্ধি হয়েছে বিজেপির।

গত কয়েকটি ভোটে নদিয়ায় ক্রমেই ক্ষয়িষ্ণু হয়েছে বামেদের ভোটব্যাঙ্ক। বাম ভোট যতটা কমেছে, ততটাই বেড়েছে বিজেপির ভোট। ২০২১ এর বিধানসভা ভোটে বাম-কংগ্রেস এক সঙ্গে লড়াই করে খালি হাতে ফেরে। নদিয়া থেকেই ন’টি আসনে জেতে বিজেপি। পুরভোটে নদিয়ায় হারানো জমি অনেকটাই পুনরুদ্ধার করে তৃণমূল। তাহেরপুর পুর বোর্ড দখল করে বামেরাও। তবে জেলার বাকি পুরসভায় খালি হাতে ফিরতে হয়েছে তাদের। তাহেরপুরের দৃষ্টান্তকে সামনে রেখেই এ বার গ্রামের ভোটে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইয়ে নেমেছে বামেরা। তরুণ প্রজন্মকে কাছে টানতে সমাজমাধ্যমকে হাতিয়ার করেছেন সিপিএম নেতৃত্ব। দলীয় সূত্রের বক্তব্য, লোকসভা এবং বিধানসভার ভোট হয়েছে ভিন্ন আঙ্গিকে। পঞ্চায়েত নির্বাচনের বিষয়টি আলাদা। সেখানে অনেকটাই গুরুত্ব পায় স্থানীয় স্তরের সমস্যা। নিচুতলার সংগঠনের শক্তিও সেখানে অনেকটাই গুরুত্বপূর্ণ। একেবারে বুথস্তর থেকেই হারানো ভোট ফিরিয়ে আনার চেষ্টা শুরু হয়েছে সিপিএমে। দলের মধ্যে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়া নেতা-কর্মীরাও অনেকটাই সক্রিয় হয়ে দলের কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন। আন্দোলনের পথে নেমে হারানো ভোট ব্যাঙ্ক, বিশেষত সংখ্যালঘু ভোট ফিরিয়ে আনার রাস্তা খুঁজছে সিপিএম। দলের নদিয়া জেলা সম্পাদক সুমিত দে বলেন, ‘‘পঞ্চায়েত নির্বাচনে নদিয়ায় ব্যাপক অংশের মানুষ ফের বামেদের ভোট দেবেন। সংখ্যালঘু অনেকটাই ফিরিয়ে আনব আমরা।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement