চ্যালেঞ্জ মোড় এর কালি, নদিয়ার কৃষ্ণনগর। ছবি: প্রণব দেবনাথ
রাত ঠিক আটটা। বাশের সাঙে করে বিশাল কালীমূর্তি কাঁধে তুলে নিল বেহারা দল। তার পর দৌড় শুরু রাজবাড়ির দিকে। সামনে কোনও ক্লাব বা বারোয়ারি পড়লে অশান্তি নিশ্চিত। গোটা কৃষ্ণনগরকে যেন চ্যালেঞ্জ করতে করতে এগিয়ে চলে প্রতিমা বিসর্জনের দিকে। সকলের বিরুদ্ধেই ক্লাব যেন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে প্রস্তুত। তাই অনেক ভেবেচিন্তে ক্লাবের নাম রাখা হল ‘চ্যালেঞ্জ’। এই পুজো কৃষ্ণনগরের মানুষের কাছে এতটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছিল যে লোকমুখে এলাকার নামই হয়ে গেল চ্যালেঞ্জের মোড়। তবে কালের সঙ্গে সঙ্গে সেই উত্তেজনা, সেই উগ্রতা আজ আর নেই। কিন্তু আবেগ রয়ে গিয়েছে ঠিক আগের মতোই। তাদের ২১ ফুটের কালী প্রতিমাই এখন কৃষ্ণনগর শহরের প্রধান আকর্ষণ।
শুরু হয়েছিল প্রায় ৬০ বছর আগে। বছর তেরোর চার বন্ধু বীরেন সেন, বিশ্বনাথ নন্দী, অঞ্জন চক্রবর্তী এবং গোপাল দে মিলে পারিয়া মার্কেটের নীচে সরস্বতী পুজো শুরু করলেন। বছরচারেক পর সেই পুজো কিছুটা এগিয়ে এল। তত দিনে সত্য সাহা, উদয় চৌধুরীর মতো আরও অনেক বন্ধু যুক্ত হয়ে গিয়েছে এই পুজোর সঙ্গে। বছর পাঁচ পর শুরু হল কালীপুজো। কালী ও সরস্বতী দুটো পুজোই করাতে থাকেন তাঁরা। ক্লাবের নাম রাখা হল ‘বঙ্গশ্রী’। আর এন ঠাকুর রোড ও বিশ্বম্ভর রায় রোডের সংযোগস্থলে বেদি তৈরি হল। আজও সেখানে পুজো হয়।
প্রথম দিকে প্রতিমা এত বড় ছিল না। প্রথম প্রতিমা ছিল দশ ফুটের। পরে উচ্চতা বাড়তে বাড়তে বর্তমানে তার উচ্চতা ২১ ফুট। যাঁদের হাত ধরে এই পুজোরসূচনা, তাঁদেরই এক জন বছর তিয়াত্তরের বীরেন সেন। তিনি বলেন, “আমরা তখন প্রায় ৮০ জন সদস্য। শহরের বিভিন্ন এলাকার যুবকেরা তখন আমাদের ক্লাবের সদস্য। পুজোর পাশাপাশি অসহায়-দরিদ্র মানুষের পাশে থাকতাম সারা বছর ধরে। কিন্তু কালীপুজোর সময় আমাদের অন্য রূপ। কাউকেই মানতাম না। শহরের প্রায় সব এলাকার পুজো উদ্যোক্তাদের সঙ্গে আমাদের গন্ডগোল লেগেই থাকত।”
তিনি আরও বলেন, “রাত ঠিক আটটার সময়ে আমাদের প্রতিমা উঠত। রাস্তায় কাউকেই মানা হত না। সামনে যে ক্লাবই পড়ুক না কেন, অশান্তি অবধারিত!”
কিন্তু ক্লাবের নাম ঠিক পছন্দ হচ্ছিল না। যুতসই নাম খোঁজা হচ্ছিল। হঠাৎ এক দিন খবরের কাগজের একটি বিজ্ঞাপনে ‘চ্যালেঞ্জ’ শব্দটা দেখতে পান ওঁরা। তখনই মাথায় খেলে যায়, এই নামই রাখতে হবে। বাকিরাও রাজি হয়ে গেল। সেই থেকে ক্লাবের নাম চ্যালেঞ্জ। বীরেন বলে চলেন, “আসলে আমরা সব বিষয়েই চ্যালেঞ্জ নিতে পছন্দ করতাম। সবাইকেই চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতাম। তাই মনে হয়েছিল এই নামটাই ঠিকঠাক।”
সময়ের সঙ্গে বয়স হয়েছে। রক্তের তেজ কমে এসেছে। ক্লাবের ব্যাটন তুলে দিয়েছেন পরবর্তী প্রজন্মের হাতে। বর্তমান সম্পাদক বরুণকান্তি ঘোষ বলেন, “একশো জন বেহারা বিশাল প্রতিমা বহন করে নিয়ে যান। সব মিলিয়ে খরচ হয় প্রায় পাঁচ লক্ষ টাকা। মূলত ব্যবসায়ীদের অনুদানেই এই পুজোর খরচতোলা হয়।”