প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় কেন্দ্রের লোগো। ফাইল চিত্র।
পঞ্চায়েত ভোটের আগে কেন্দ্রীয় বরাদ্দের বন্ধ দরজা খুলতে মরিয়া রাজ্য সরকার। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা রূপায়ণের প্রশ্নে গত ১৫ তারিখ কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রককে একটি ৫০ পাতার পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট জমা দিল রাজ্যের পঞ্চায়েত এবং গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক। কৃষি ভবন সূত্রে এই খবর জানা গিয়েছে।
কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশ মানার ক্ষেত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের নানা বিচ্যুতি এবং পঞ্চায়েতের কাজে দুর্নীতির অভিযোগ এর আগেও তুলেছে কেন্দ্র। এ ব্যাপারে রাজ্যকে বেশ কিছু কারণ দর্শাতে এবং ব্যবস্থা নিতেও নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক। রাজ্যের ওই রিপোর্টে সাম্প্রতিক কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষকদের দলের পনেরোটি জেলা সফরের ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনাকে ঘিরে অভিযোগ এবং প্রস্তাবের জবাব দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন জেলায় এই আবাসনগুলিতে কেন্দ্রের লোগো নেই, কাজ অর্ধসমাপ্ত, শৌচাগারহীন, স্থানীয় কর্তাদের ঘুষ দিতে হয়েছে— এমন অভিযোগগুলির ‘কেস টু কেস’ জবাব ওই রিপোর্টের মাধ্যমে দিয়েছে রাজ্য। কেন্দ্রীয় প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে কী কী পদক্ষেপ রাজ্য সরকার করেছে, তারও খতিয়ান দেওয়া হয়েছে।
কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক দলের সুপারিশ মেনে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় অনৈতিকতার অভিযোগও তোলা হয়েছিল রাজ্যের বিরুদ্ধে। সেই অনুযায়ী আধিকারিক এবং উপভোক্তাদের বিরুদ্ধে এফআইআর-ও দাখিল করা হয়েছিল। এ ব্যাপারে তৃণমূল নেতৃত্বের বক্তব্য, ‘রাজনীতির লড়াইয়ে হেরে গিয়ে বিজেপি সরকার বাংলা ভাগের ষড়যন্ত্র করছে। পাশাপাশি বাংলার মানুষের নায্য পাওনা আটকে রেখে আর্থিক অবরোধ তৈরি করছে।’
যে ‘অ্যাকশন টেকন রিপোর্ট’টি সম্প্রতি কেন্দ্রকে পাঠিয়েছে রাজ্য, তার মধ্যে একদিকে জেলাওয়াড়ি ভাবে কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দলের পর্যবেক্ষণগুলি রাখা হয়েছে। আর তার ঠিক পাশেই রাখা হয়েছে রাজ্যের পদক্ষেপের কথা। যেমন বাঁকুড়ার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় দলের বক্তব্য, ‘আবাস যোজনায় তৈরি হওয়া বাড়িগুলিতে কেন্দ্রীয় লোগো নেই। কিছু বাড়ির আকার আয়তন দেখে মনে হচ্ছে উপভোক্তা যথেষ্ট বড়লোক। তাঁদের এই যোজনার সুবিধা নেওয়ার প্রযোজন ছিল না। গ্যাস এবং বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়নি অনেক ক্ষেত্রে। দেওয়ালে প্লাস্টারের কাজ শেষ না করে প্লাস্টিকের স্টিকার সেঁটে রাখা হয়েছে। অথচ নিয়ম অনুযায়ী, দেওয়ালে প্লাস্টার করে উপভোক্তার পরিচয় এবং যোজনার লোগো এঁকে রাখার কথা।’ জবাবে রাজ্য সেখানকার বাড়ির ছবি সঙ্গে দিয়ে দেখিয়েছে, ‘দেওয়ালে প্রয়োজনীয় তথ্য ও লোগো এঁকে দেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসন নির্দেশ দিয়েছে পাকাপাকি ভাবে যোজনার নাম খোদাই করতে।’ বড়লোক উপভোক্তা প্রসঙ্গে রাজ্যের জবাব, ‘যাঁদের কথা বলা হচ্ছে, তাঁরা যোজনার জন্য বরাদ্দ পুরো অর্থটাই খরচ করেছেন। স্থানীয় গ্রামীন মানুষের প্রবণতা রয়েছে নিজেদের পরিবারের জন্য বড় বাড়ি বানানো। তাঁরা সে ক্ষেত্রে ঋণ নিয়েছেন এবং নিজেদের কষ্টার্জিত সঞ্চয় বাড়ি তৈরিতে খরচ করেছেন।’
বীরভূমের শীর্ষা গ্রাম পঞ্চায়েতের একাধিক বাড়ির কথা উল্লেখ করে কেন্দ্রীয় দলের অভিযোগ, ‘কোথাও টয়লেট নেই, ছাদ তৈরি হয়নি, বাসযোগ্য অবস্থায় নেই অনেক বাড়ি। কিছু বাড়ি আবার নির্ধারিত আয়তনের তুলনায় বড়। এ রকম বড় মাপের বাড়ি অনেকের থাকলে, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার অধীনে যাঁরা অভাবী, তাঁদের উপর এই অসাম্যের প্রভাব পড়বে।’ উত্তরে রাজ্যের বক্তব্য, ‘যখন প্রতিনিধি দল পর্যবেক্ষণে এসেছিল, তখন কাজ সম্পূর্ণ হয়নি। পরে কাজ শেষ হয়েছে। সেই ছবিও রিপোর্টে দেওয়া হয়েছে।’ আবার একটি ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে, পরিদর্শকরা সামনে থেকে দেখে, কথা বলে চলে গিয়েছেন। টয়লেট ছিল বাড়ির পিছন ভাগে। প্রমাণ হিসাবে ছবিও দেওয়া হয়েছে।
ঝাড়গ্রামের জামবনি ব্লকে ৮ জন উপভোক্তার নাম উল্লেখ করে কেন্দ্রীয় দল জানিয়েছে, ‘এঁরা স্বীকার করেছেন, ১০ থেকে ৫০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে স্থানীয় আধিকারিকদের। কিন্তু কারা সেই টাকা নিয়েছেন, সে কথা উপভোক্তারা বলতে চাননি। তবে একটি ক্ষেত্রে একজন ‘সাজ্জাদ আলি’ নামে এক ব্যক্তিকে ঘুষখোর হিসাবে উল্লেখ করেছে।’ রাজ্যকে এই সাজ্জাদ আলির বিষয়ে খোঁজখবর করতে নির্দেশ দেয় কেন্দ্র। রাজ্য এই আট জনের বক্তব্য রিপোর্টে সংযুক্ত করে পাঠিয়েছে। রাজ্যের বক্তব্য, ‘কেন্দ্রের অভিযোগের ভিত্তিতে ঝাড়গ্রাম জেলা পরিষদ ওই বাড়িগুলিতে গিয়ে ক্যামেরার সামনে এ ব্যাপারে তাঁদের কাছে জানতে চায়। কিন্তু কেউ স্বীকার করেননি যে, তাঁদের ঘুষ দিতে হয়েছে।’ রিপোর্টের বক্তব্য, ‘এই উপভোক্তারা তিনটি কিস্তিতেই টাকা পেয়েছেন। বাড়ি তৈরিতে তা তাঁরা কাজে লাগিয়েছেন। এর পর এক সাব-ইন্সপেক্টরের অধীনে পুলিশের একটি দল বিষয়টির বিস্তারিত তদন্ত করেছে। কোনও ঘুষ-কাণ্ড শনাক্ত হয়নি। সাজ্জাদ আলি বলে কারও নামও উঠে আসেনি। তাঁদের ব্যাঙ্কের পাস বইয়ের ফটোকপিও রিপোর্টে দেওয়া হয়েছে। যেখানে দেখা যাচ্ছে, তারা তিনটি কিস্তির টাকা পেয়েছেন এবং তা তুলেছেন।’
উত্তর দিনাজপুরের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষকদের বক্তব্য ছিল, ‘কিছু ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, অনেক বাড়িতেই টিনের চাল। উপভোক্তারা জানিয়েছেন, তাঁদের কাছে টাকা শেষ হয়ে যাওয়ায় টিন দিয়ে মাথার চাল করতে হয়েছে। আবার কিছু বাড়ির ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, দু’ থেকেতিন লাখ টাকা বাড়তি খরচ করে বাড়ির আয়তন বাড়ানো হয়েছে। যাঁদের দু’তিন লাখ টাকা খরচ করার ক্ষমতা রয়েছে, তাঁরা এই যোজনার আওতায় আসার যোগ্য কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।’ এ ব্যাপারে রাজ্যের বক্তব্য, ‘উত্তর দিনাজপুর জোন ডি-তে পড়ে। সেখানে করোগেটে়ড জি আই শিট বাড়ির মাথার চাল হিসাবে ব্যবহার করা হয়। বাড়ি তৈরির প্রযুক্তি অঞ্চলভেদে ভিন্ন হয়।’ পাশাপাশি বড় মাপের বাড়ি সম্পর্কে আগের বক্তব্যেরই পুনরাবৃত্তি করে বলা হয়েছে, ‘যাঁরা মাপে বড় বাড়ি চেয়েছেন, তাঁরা তাঁদের সঞ্চয় এর পিছনে খরচ করেছেন।’