গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
গোটা ৩৬৬ দিনের বছর শেষের মুখে। যে বছর দেখেছে লোকসভা ভোট। আরজি কর নিয়ে অভূতপূর্ব নাগরিক আন্দোলন। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর— বঙ্গ রাজনীতিতে ১২ মাসে ঘটনার ঘনঘটা। বছরের শেষে সেই ঘটনা পরম্পরায় নজর রাখলে দেখা যাচ্ছে আন্দোলন, বিরোধিতা, সমালোচনার ‘ধাক্কা’ সামলে নিয়েছে শাসকদল তৃণমূল। প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার ক্ষোভ আছে, তা যেমন সত্য, তেমনই বাস্তব যে, উপনির্বাচনে শাসকদলের কোনও ক্ষয় হয়নি। বরং ভাল হয়েছে। যদিও ২৯৪টি আসনের মধ্যে মাত্র ছ’টির ফলাফল ‘সূচক’ হিসেবে খুব যুতসই নয়। উল্টো দিকে, বছরের শুরু থেকে যে গর্জন শুরু করেছিল রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপি, সম্বৎসর তা থেকে বর্ষণ বিশেষ হয়নি। বছরের শেষে দেখা যাচ্ছে বাংলায় আগের থেকেও খারাপ পরিস্থিতিতে পদ্মশিবির। বাম-কংগ্রেসের অবস্থা ‘অপরিবর্তনীয়’, তারা এখনও বঙ্গ রাজনীতিতে ‘প্রান্তিক শক্তি’।
লোকসভা ভোট ছিল এ বছর বাংলার রাজনৈতিক দলগুলির কাছে সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। সেই ভোটের ফল বলেছে, বঙ্গে ২২ থেকে বেড়ে ২৯ হয়েছে তৃণমূল। আর ১৮ থেকে ১২-তে নেমে গিয়েছে বিজেপি। কংগ্রেসও দু’টি আসন থেকে কমে একটি আসনে গিয়ে ঠেকেছে। পাঁচ বারের সাংসদ অধীররঞ্জন চৌধুরী হেরে গিয়েছেন বহরমপুরে। নবীন-প্রবীণ মিশ্রণে প্রার্থিতালিকা করেও শূন্যের গেরো কাটাতে পারেনি সিপিএম-সহ বামেরা।
তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ মেনে নিয়েছেন, ‘চাপ’ তৈরির চেষ্টা হয়েছিল। তবে মানুষের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগের কারণে তা কোনও প্রভাব ফেলতে পারেনি। কুণালের কথায়, ‘‘তৃণমূলের সংগঠনের সঙ্গে জনগণের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। বিরোধীরা যে আবহ তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন, তা কেবল সংবাদমাধ্যম আর সমাজমাধ্যমেই সীমাবদ্ধ।’’ রাজ্যসভার বিজেপি সাংসদ শমীক ভট্টাচার্যের বক্তব্য, ‘‘অনেকেই হয়তো ভাবছেন, লোকসভা নির্বাচনের পরে বিজেপি ছন্নছাড়া। বিজেপির নির্দিষ্ট পদ্ধতি রয়েছে। মানুষ আমাদের যে ভাবে দেখতে চান, খুব তাড়াতাড়িই দেখতে পাবেন।’’ সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘আমাদের নানা ধরনের লড়াই করতে হচ্ছে। বছরের শুরুতে এক রকম ছিল। শেষে আর এক রকম। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে যে বাঙালি গর্ব করত, এখন সেটাও আক্রান্ত হচ্ছে। ফলে আমাদের লড়াইয়ের অনেক দিক রয়েছে।’’ আবার প্রদেশ কংগ্রেসের অন্যতম মুখপাত্র সুমন রায়চৌধুরীর কথায়, ‘‘কংগ্রেস সাংগঠনিক ভাবে দুর্বল। রক্তক্ষরণ ঘটিয়ে কংগ্রেসকে দুর্বল করেছেন মমতা। তার মধ্যেও আমাদের নতুন করে সব করতে হচ্ছে।’’
জোড়া ধাক্কা সামলেছে তৃণমূল
বছরের শুরুতেই সংবাদ শিরোনামে চলে আসে সন্দেশখালি। রেশন দুর্নীতি মামলায় ৫ জানুয়ারি সন্দেশখালির তৃণমূল নেতা শেখ শাহজাহানের বাড়িতে হানা দিয়েছিল ইডির দল। কিন্তু ‘শাহজাহান বাহিনী’র প্রহারে রক্তাক্ত হয়ে ফিরতে হয় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার আধিকারিকদের। তার পর থেকে সন্দেশখালির নানাবিধ ঘটনা প্রকাশ্যে আসতে থাকে। ধারাবাহিক ভাবে অভিযোগ উঠতে থাকে, দ্বীপাঞ্চলের মহিলাদের ‘সম্ভ্রম’ বলে কিছু রাখেনি তৃণমূলের বাহিনী। তৃণমূলের পার্টি অফিসে ডেকে পাঠিয়ে মহিলাদের নানাবিধ নির্যাতন করা হত বলেও অভিযোগ উঠতে থাকে। কোমর বেঁধে নামে বিজেপি। জাতীয় মহিলা কমিশন, বিজেপির নেতানেত্রী, সিপিএমের নেতানেত্রীরা যেতে থাকেন ওই জনপদে। টানা প্রায় আড়াই মাস ধরে সন্দেশখালি ঘিরে তৃণমূল-বিরোধী ভাষ্য যখন ‘বিশ্বাসযোগ্য’ পর্যায়ে যেতে শুরু করেছে, তখন পাল্টা এক গোপন ক্যামেরা অভিযান ‘হাতিয়ার’ করে ময়দানে নামে শাকদল। যে অভিযানের সারমর্ম ছিল— প্রচুর অর্থব্যয় করে, মদের যোগান দিয়ে বিজেপি সন্দেশখালির ‘চিত্রনাট্য’ সাজিয়েছিল। স্থানীয় বিজেপি নেতাকে সে সব বলতেও শোনা যায় ভিডিয়োতে। তার পরেই সন্দেশখালি আর ‘একপেশে’ থাকেনি। বরং পাল্টা রাজনৈতিক আক্রমণে নামে শাসক শিবির। ঘটনাচক্রে, বৃহস্পতিবারই মমতা জানিয়েছেন, তিনি আগামী সোমবার সন্দেশখালি যাবেন।
সন্দেশখালির ঘটনাক্রম তৃণমূলের মহিলা ভোটে প্রভাব ফেলতে পারে, এমন একটা আশঙ্কা শাসমহলে ছিল। কিন্তু লোকসভা ভোটে দেখা যায়, বসিরহাট লোকসভায় (সন্দেশখালি এই লোকসভাতেই) হাসতে হাসতে জিতেছে তৃণমূল। তবে সন্দেশখালি বিধানসভায় এগিয়ে ছিল বিজেপি। পদ্মশিবির প্রার্থী করেছিল সন্দেশখালির গৃহবধূ, নিজেকে তৃণমূলের হাতে ‘নির্যাতিতা’ বলে দাবি করা রেখা পাত্রকে। যাঁকে ফোন করেছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তবে সন্দেশখালি বিধানসভার ফলাফলের সঙ্গে রাজ্যের সার্বিক ফলের সাযুজ্য ছিল না। ফলে তৃণমূলও সন্দেশখালিকে ‘বিচ্ছিন্ন দ্বীপ’ হিসাবেই দেখাতে চেয়েছে।
কিন্তু দু’মাস যেতে না যেতেই আবার ‘ধাক্কা’ এসে পড়ে তৃণমূল তথা রাজ্য সরকারের সামনে। অগস্টে প্রকাশ্যে আসে আরজি কর হাসপাতালের মধ্যে এক চিকিৎসকের ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনা। সেই ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয়। নাগরিক আন্দোলনের নতুন মাইলফলক লিখতে শুরু করে বাংলা। চাপ তৈরি হয় পুলিশ, প্রশাসন, সরকারের উপর। তৃণমূলের প্রথম সারির নেতারা প্রায় সকলেই গুটিয়ে যান। কারণ, তাঁরা বিলক্ষণ বুঝতে পারেন, ১৩ বছরের মমতা জমানায় এই প্রথম এতটা চাপে পড়তে হয়েছে দল এবং সরকারকে। সেই চাপের সামনে প্রাথমিক কলকাতার পুলিশ কমিশনার-সহ পুলিশ ও স্বাস্থ্য প্রশাসনের একাধিক কর্তাকে সরিয়ে দিতে হয়েছিল মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে। অগস্ট থেকে শুরু হওয়া সেই আন্দোলন পুজোর পর পর্যন্তও তেজিয়ান ছিল। জুনিয়র চিকিৎসকদের আন্দোলনের সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল সরকার-বিরোধী ক্ষোভ। যদিও তা ছিল মূলত শহরাঞ্চলেই সীমাবদ্ধ। ধর্মতলায় জুনিয়র ডাক্তারদের অনশনমঞ্চ হয়ে উঠেছিল উৎসবের মধ্যেও আন্দোলনের মণ্ডপ। পুজোর পরে নবান্নে মমতার সঙ্গে বৈঠকের পর জুনিয়র ডাক্তারেরা অনশন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর থেকেই আন্দোলন ক্রমশ নিষ্প্রভ হয়ে পড়তে থাকে। অক্টোবরেও আরজি কর নিয়ে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনে ধর্মতলায় যে তেজ ছিল, ডিসেম্বরে সিনিয়র ডাক্তারদের মঞ্চ ঘিরে সেই ‘বিপ্লবী স্পর্ধা’ উধাও।
এর মধ্যেই রাজ্যে ছ’টি উপনির্বাচন হয়। লোকসভা ভোটে শহরাঞ্চলে তৃণমূলের ফল ভাল হয়নি। আরজি কর নিয়ে নাগরিক আন্দোলন আলোড়িত করেছিল শহর-মফস্সলকেই। কিন্তু দেখা যায় মেদিনীপুর, নৈহাটির মতো শহরাঞ্চলের বিধানসভাতেও তৃণমূল জিতেছে। বিরোধীরা দাঁড়াতেই পারেনি। যা থেকে স্পষ্ট হয়েছে, আরজি করের নাগরিক আন্দোলনের কোনও ছাপ ভোটবাক্সে পড়েনি। ঢেউ উঠেছিল ঠিক কথা। আবার এ-ও বাস্তব যে, তৃণমূল আপাতত তা সামলে নিয়েছে।
গর্জনই সার বিজেপির, বর্ষণ নয়
বছরের গোড়া থেকে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলতেন, লোকসভা ভোটে বিজেপি বাংলায় এত আসন জিতবে যে, ২০২৬ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে না। তার আগেই বিধানসভা ভোট হয়ে যাবে এবং তৃণমূলের বিদায় নিশ্চিত। বছরের গোড়ায় অমিত শাহ এসেও ৩০টি আসন জেতার কথা বলে গিয়েছিলেন। মার্চ মাসে ভোট ঘোষণার আগে কৃষ্ণনগরে সভা করতে এসে মোদীও হুঙ্কার দিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু বছরশেষে দেখা যাচ্ছে, শুরুতে যতটা গর্জেছিল বিজেপি, তার ১০ শতাংশও বর্ষায়নি।
সারা দেশেই লোকসভা ভোটে বিজেপি ধাক্কা খেয়েছে। একক ভাবে জাদুসংখ্যা ছুঁতে পারেনি পদ্মশিবির। বাংলাতেও তার অন্যথা হয়নি। দিলীপ ঘোষের মতো নেতাকে আসন বদলে অন্য কেন্দ্রে লড়তে পাঠিয়েছিল বিজেপি। তিনি হেরেছেন। গত সরকারে শাহের ‘ডেপুটি’ নিশীথ প্রামাণিক পরাস্ত হয়েছেন কোচবিহারে। যে উত্তরবঙ্গ হয়ে উঠেছিল বিজেপির ‘গড়’, সেখানে ভাঙন ধরিয়েছে তৃণমূল। পাঁচ বছর আগের লোকসভা ভোটে উত্তরবঙ্গের পাশাপাশি জঙ্গলমহলেরও সব লোকসভা আসন জিতেছিল পদ্মশিবির। এ বার সেখানেও ভিত ধসে পড়েছে বিজেপির। তৃণমূল ছিনিয়ে নিয়েছে বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম, মেদিনীপুরের মতো আসন। বাঁকুড়ায় পরাস্ত গত মেয়াদের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুভাষ সরকার। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী দেবশ্রী চৌধুরীও হেরে যান দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা আসনে। তাঁকে রায়গঞ্জ থেকে কলকাতায় এনে দাঁড় করিয়েছিল বিজেপি। সাফল্য বলতে মতুয়া গড়ে জয় অটুট রাখা। রানাঘাট এবং বনগাঁ— দু’টি আসনই ধরে রেখেছে বিজেপি।
সন্দেশখালিকে অস্ত্র করে তৃণমূলকে ভোটবাক্সে বেগ দিতে পারেনি বিজেপি। আরজি কর নিয়ে গোড়ায় আগ্রাসী আন্দোলন করলেও সময়ে গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে গুটিয়ে গিয়েছে তারা। বছরের শেষে দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা বারংবার প্রকাশ্যে এসে পড়ছে। সদস্য সংগ্রহ অভিযানেও আশানুরূপ জায়গায় পৌঁছতে পারেনি তারা। যা নিয়ে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সুকান্তদের উপর ‘ক্ষুব্ধ’।
আরজি করের ঘটনার কয়েক দিন আগেই নাগরিক আন্দোলনের তেজে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশ ছেড়ে ভারতে চলে আসতে হয়েছিল। আরজি কর আন্দোলনের শুরুতে শুভেন্দুরাও বাংলাদেশের ঢঙে স্লোগান দিতেন—‘দফা এক, দাবি এক, মমতার পদত্যাগ’। নাগরিক আন্দোলনের যে অভিঘাত তৈরি হয়েছিল, তাতেও নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ‘প্রভাব’ ছিল। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে ‘মেরুকরণের’ পুরনো হাতিয়ারেই নতুন করে ধার দিতে চাইছে বিজেপি। যে হাতিয়ার নিয়ে ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচন এবং ২০২৪ সালের লোকসভা ভোট করেছিল তারা।
সেই তিমিরেই বাম-কংগ্রেস
২০২৩ সালের শুরু থেকে শুরু হয়েছিল সিপিএমের যুব সংগঠন ডিওয়াইএফআইয়ের ডাকে ‘ইনসাফ যাত্রা’। ৫০ দিন ব্যাপী সেই যাত্রা শেষে বছরের শুরুতেই ৭ জানুয়ারি ব্রিগেডে সমাবেশ করেছিলেন মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায়েরা। সেই সভায় ভিড়ও হয়েছিল। কিন্তু ভোটে দেখা গেল ব্রিগেডে লোক হলেও বুথে লোক নেই সিপিএমের। মসৃণ ভাবে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট হয়েছিল। রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম লড়তে গিয়েছিলেন মুর্শিদাবাদে। সুজন চক্রবর্তীর মতো নেতা লড়েছিলেন দমদমে। প্রবীণদের পাশাপাশি নবীন অংশের সৃজন ভট্টাচার্য, দীপ্সিতা ধরেরা লড়েছিলেন লোকসভায়। কিন্তু সিপিএম থেকে গিয়েছে শূন্যেই। বামেদের মাত্র দু’জন প্রার্থী জামানত রাখতে পেরেছিলেন— সুজন এবং সেলিম। যা স্পষ্ট করে দিয়েছে, বঙ্গ রাজনীতি আপাতত দ্বিমেরু অক্ষেই আবর্তিত হচ্ছে। ‘নাটকীয়’ কিছু না ঘটে গেলে এখনই তা বদলের সম্ভাবনা নেই। কংগ্রেসের ক্ষয়িষ্ণু দশা জারি রয়েছে। অধীর হেরে গিয়েছেন। তা-ও আবার ইউসুফ পাঠানের মতো উড়ে আসা প্রার্থীর কাছে। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি পদে অধীরের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন শুভঙ্কর সরকার। কিন্তু অতি বড় কংগ্রেসিও হয়তো জানেন , সভাপতি বদলেও দলের অবস্থা বদল করা অসম্ভব। ভোটে জোট সমীকরণ নিয়ে বাম-কংগ্রেস নানাবিধ পরীক্ষানিরীক্ষা করলেও নতুন কোনও আবিষ্কার করতে পারেনি।
২০২৫ সালকে তিন পক্ষই ব্যবহার করবে ২০২৬ সালের ‘মহড়ার বছর’ হিসাবে। ‘সম্ভাবনার শিল্প’ রাজনীতিতে কি বদল হবে?