নন্দিনীর বিরুদ্ধে তদন্তের ভাবনা নবান্নের। — ফাইল চিত্র।
রাজভবন থেকে সরে যেতে হয়েছে রাজ্যপালের প্রধান সচিব নন্দিনী চক্রবর্তীকে। বুধবারই বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নবান্ন জানিয়েছে, এখন তিনি পর্যটন দফতর সামলাবেন। কিন্তু সেখানেই এই আইএএসের ‘বিড়ম্বনা’ শেষ হয়নি। এ বার তাঁকে বিভাগীয় তদন্তের মুখোমুখিও হতে হবে বলে নবান্নের একটি সূত্রের দাবি। বস্তুত, সেই প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে বলেই ওই সূত্রটি দাবি করেছে।
রাজ্যপালের প্রধান সচিব পদে থাকার সময়ে নন্দিনীর বিরুদ্ধে শাসকদল তৃণমূলের প্রতি ‘পক্ষপাত’ করার অভিযোগ তুলেছিল বিজেপি। শুধু সেই কারণেই কি নন্দিনী ‘অপছন্দের’ হয়ে যান রাজ্যপালের কাছে? যাঁর রাজভবন সফরের পরে এত কাণ্ড, সেই রাজ্য বিজেপির সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলছেন, ‘‘আমার কথায় উনি প্রধান সচিবকে সরাতে চেয়েছেন বলে মনে হয় না।’’ তবে রাজভবন সূত্র বলছে, অন্য কারণে নন্দিনীর উপর ‘রুষ্ট’ হন আনন্দ। সেই অভিযোগই তিনি নবান্নকে জানান। রাজভবনের তরফে রাজ্যের মুখ্যসচিব এবং স্বরাষ্ট্রসচিবকে বিষয়টি জানানো হয়েছিল। বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল মুখ্যমন্ত্রীর কাছেও। রাজভবন নন্দিনীর বিরুদ্ধে ‘সেন্ট্রাল সার্ভিস রুল’ অনুসারে তদন্ত চাইছে বলেই অসমর্থিত সূত্রের খবর। কারণ, রাজ্যপাল নিজের ‘টিম’ নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। সেই সংক্রান্ত ফাইলটি পাঠাতে নন্দিনী ‘গড়িমসি’ করেছিলেন। সে কারণেই রাজ্যপাল তাঁর উপরে রুষ্ট হন।
নন্দিনীর ওই ‘ভূমিকা’ বিভাগীয় তদন্ত শুরুর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলেই সূত্রের দাবি। যদিও রাজভবন বা নবান্ন— বৃহস্পতিবার পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোনও পক্ষই আনুষ্ঠানিক কোনও ঘোষণা করেনি। তবে শাসক তৃণমূল বিষয়টি ‘সাদা চোখে’ দেখছে না। বরং রাজ্যপাল কিছু দিন আগে পর্যন্ত বাংলার প্রতি তাঁর আগ্রহ নিয়ে যা যা দাবি করেছিলেন, সেগুলি ‘নাটক’ বলে সন্দেহ প্রকাশ করেছে।
রাজভবন সূত্রের খবর, নন্দিনীকে প্রধান সচিব পদে রেখেই আনন্দ একটি উপদেষ্টামণ্ডলী গড়তে চেয়েছিলেন। ঠিক করেছিলেন, দেশের বিভিন্ন রাজ্য থেকে তাঁর পছন্দের কয়েক জনকে নিয়ে হবে সেই উপদেষ্টামণ্ডলী। সেই সংক্রান্ত ফাইল পাঠানো নিয়েই আনন্দ-নন্দিনীর মনোমালিন্য শুরু। সেই ফাইল পাঠানো নিয়ে ‘গড়িমসি’ দেখান নন্দিনী। আনন্দের পছন্দের ‘নতুন টিম’ গড়ায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি হওয়াতেই নন্দিনীকে সরিয়ে দেওয়ার বিষয়ে মনস্থ করেন আনন্দ। সেই সংক্রান্ত অভিযোগপত্র তিনি পাঠান নবান্নে। অসমর্থিত সূত্রের খবর, তাতে রাজ্যপাল লেখেন, রাজভবন ও নবান্নের মধ্যে ‘দূরত্ব’ তৈরি করে দিচ্ছেন নন্দিনী। তবে এখনও পর্যন্ত নবান্নের পক্ষে সেই চিঠির কথা সরকারি ভাবে স্বীকার করা হয়নি।
নন্দিনী রাজভবনকে ‘বিপথে’ চালিতে করছেন বলে প্রথম প্রকাশ্যে অভিযোগ করেন শুভেন্দু। নন্দিনীকে রাজভবন থেকে সরিয়ে পর্যটন দফতরে পাঠানোর পরে শুভেন্দু বলেন, ‘‘রাজ্যপাল পণ্ডিত মানুষ। উনি সংবিধান রক্ষা করবেন বলেই আমার বিশ্বাস।’’ তৃণমূল অবশ্য বিষয়টিকে সহজ চোখে দেখছে না। বলা হচ্ছে, রাজ্যপালের উপদেষ্টামণ্ডলী গঠনে কিছু ‘পদ্ধতিগত ত্রুটি’ ধরে দিয়েছিলেন নন্দিনী। একই সঙ্গে দাবি করা হচ্ছে, সেই প্রস্তাবিত উপদেষ্টামণ্ডলীতে কোনও বাঙালি ছিলেন না। দলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক তথা মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বৃহস্পতিবার বলেন, ‘‘রাজ্যপাল দক্ষ বাঙালি মহিলা অফিসারকে সরালেন। কিন্তু রাজ্যপালের উপদেষ্টামণ্ডলীতে কোনও বাঙালি আমলার নাম নেই কেন? কেন্দ্রে বা অন্য রাজ্যে বহু কৃতী বাঙালি অফিসার ছিলেন বা আছেন।’’ পাশাপাশিই অবশ্য কুণাল বলেন, ‘‘যদিও গোটাটাই প্রশাসনিক বিষয়। দল এ সবে জড়াবে না।’’ কিন্তু নন্দিনীকে ‘অপমানজনক ভাবে’ সরানো হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।
বস্তুত, রাজ্যপালের বাংলা এবং বাংলা ভাষার প্রতি আগ্রহ প্রকাশ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন কুণাল। রাজ্যপাল পদের দায়িত্ব পাওয়ার পরেই আনন্দ জানিয়েছিলেন, তিনি বাংলা শিখছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘একনিষ্ঠ পাঠক’ বোস রোজ একটি করে নতুন বাংলা শব্দ শিখবেন বলেও জানিয়েছিলেন। এর পরে ঘটা করে রাজ্যপালের ‘হাতেখড়ি’ হয় সরস্বতী পুজোর দিন। সেখানে হাজির ছিলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ ছিল কুণালেরও। সেখানে উপস্থিত না থাকলেও রাজ্যপালের উদ্যোগের প্রশংসাই করেছিলেন তিনি। বৃহস্পতিবার সেই কুণালই বলেন, ‘‘হাতেখড়ির পরে তিনি কতটা শিখেছেন, সেটা জানতে তো পড়া ধরতে হবে! সত্যিই হাতেখড়ি ছিল না কি নাটক ছিল! যদি বাংলাকেই বুঝতে হয়, তবে এই রাজ্য বা দেশের অন্যত্র অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি আমলা তো কম নেই। আর তিনি কিনা একজন বাঙালি এবং মহিলা আইএএসকে অপমানজনকভাবে সরালেন!’’