প্রতীকী ছবি।
গত মার্চে গ্রামীণ পরিকাঠামো নির্মাণ সংক্রান্ত কাজের টেন্ডারের এক্তিয়ার জেলা পরিষদের হাত থেকে কার্যত ‘কেড়ে নিয়ে’ কেন্দ্রীভূত করেছিল পঞ্চায়েত দফতর। সেই দায়িত্ব বর্তেছিল পঞ্চায়েত দফতরের অধীনস্থ রাজ্য গ্রামীণ উন্নয়ন সংস্থার (এসআরডিএ) উপরে। তাদের তত্ত্বাবধানে প্রায় ১২০টি প্রকল্পের টেন্ডার ডেকে ইতিমধ্যেই কাজের বরাত দেওয়াও হয়েছে।
সূত্রের খবর, মাস সাতেকের মাথায় সম্প্রতি আবার বিকেন্দ্রীকরণের রাস্তায় হাঁটছে রাজ্য। ফারাক হল, সংশোধিত ব্যবস্থায় টেন্ডার কমিটির মাথায় জেলাশাসককে রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। নতুন তৈরি ওই কমিটিতে জেলার অতিরিক্ত জেলাশাসক (জেলা পরিষদ)থাকলেও, নির্বাচিত পদাধিকারীদের কাউকেই রাখা হয়নি। পরিমার্জিত ব্যবস্থাটি শেষ পর্যন্ত কতটা স্থানীয় ‘রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত’ থাকবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধীরা।
বলা হয়, পঞ্চায়েতের অন্যতম মূল মন্ত্রই বিকেন্দ্রীকরণ। গ্রাম বাংলার মানুষের অভাব-অভিযোগ-চাহিদা বুঝে কাজ হওয়ার কথা ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থায়। সেই তত্ত্বেই এতদিন পর্যন্ত গ্রামীণ পরিকাঠামো উন্নয়ন তহবিলের (আরআইডিএফ) আওতাধীন রাস্তা-সাঁকো-সেতুর মতো পরিকাঠামো তৈরির দায়িত্ব ছিল জেলা পরিষদের উপরে।
কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই সরকারি কাজের বরাত ঘিরে দুর্নীতি এবং টাকার বখরা নিয়ে শাসকদলের মধ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের অভিযোগ উঠেছে। জেলায়-জেলায় তৃণমূল নেতাদের একাংশের আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন সম্পত্তি বা প্রাসাদোপম বাড়ির তথ্য এসেছে জনসমক্ষে। তোলাবাজি-কাটমানি বা সরকারি প্রকল্পে দুর্নীতি নিয়ে বারে বারে সতর্ক করতে হয়েছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও। অনেকের মতে, তাই ‘প্রশাসনিক বাধ্যবাধকতা’ এই সংশোধন-ভাবনার নেপথ্যে কাজ করছে। জেলা পরিষদের বদলে দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছে জেলা প্রশাসনের উপরে।
সূত্রের খবর, কয়েকমাস আগেই মুখ্যসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদী বৈঠক করে টেন্ডার এবং কাজের উপরে নজর রাখার পরামর্শ দিয়েছিলেন জেলাশাসকদের। তখনই রাজ্যের এই অবস্থান বদলের ইঙ্গিত মিলেছিল। প্রশাসনের এক কর্তার বক্তব্য, “দায়িত্ব বাড়বে জেলাশাসকদের। আরআইডিএফ-২৭ এর আওতায় কাজের টেন্ডার হয়েছে এসআরডিএ-র তত্ত্বাবধানে। আরআইডিএফ-২৮ থেকে টেন্ডার কমিটির মাথায় জেলাশাসকেরা থাকবেন। এসআরডিএ-র প্রতিনিধি, ইঞ্জিনিয়ারেরাও রয়েছেন কমিটিতে।”
মার্চ থেকে আরআইডিএফ আওতাধীন কাজগুলির টেন্ডার জেলা পরিষদের বদলে সামলাচ্ছিল এসআরডিএ। ইঞ্জিনিয়ারেরাই কাজের পরিকল্পনা, বিস্তারিত প্রকল্প রিপোর্ট (ডিপিআর) তৈরির দায়িত্ব সামলাচ্ছিলেন। প্রশাসনিক সূত্রের বক্তব্য, টেন্ডার ঘোষণার আগে কাজ নির্বাচনের তথ্য জানতেই পারছিলেন না জেলাশাসক এবং জেলা পরিষদ। এ নিয়ে জেলায় জেলায় ‘জটিলতা’ তৈরির সম্ভাবনা বাড়ছিল। এখনকার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আড়াই কোটি টাকা পর্যন্ত টেন্ডার ডাকবেন এসআরডিএ-র এগজ়িকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার। তা জানানো হবে কমিটিকে। আড়াই কোটির বেশি টেন্ডার হলে তা ডাকবেন সুপারিন্টেন্ডিং ইঞ্জিনিয়ার। সেটাও কমিটিকে জানাতে হবে। জেলাশাসক নজর রাখবেন কাজকর্মে।
এক কর্তার কথায়, “আরআইডিএফ-২৮-এর আওতায় কাজের তালিকা তৈরি করে অক্টোবরের মধ্যে টেন্ডার-প্রক্রিয়া এবং কাজের বরাত দেওয়া শেষ করে ফেলাই লক্ষ্য। যাতে নভেম্বর থেকে কাজ শুরু করে দেওয়া যায়। এবং তার পরে পঞ্চায়েত ভোট ঘোষণা হলে, যেন তা থামাতে না হয়।”
আধিকারিকদের অনেকের বক্তব্য, এলাকায় কী কাজের পরিকল্পনা চলছে, তার অগ্রাধিকার কী হবে, কোন কাজগুলি করার সিদ্ধান্ত হচ্ছে, তা না জানলে পঞ্চায়েতের ভোটপ্রার্থীরা প্রচারে উন্নয়নের তথ্য রাখতে পারবেন না। এলাকায় কোন প্রকল্পটি জরুরি, তার অগ্রাধিকার নির্ধারণে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাঁদের বাদ দিয়ে কাজ হলে কম গুরুত্বের কাজ অগ্রাধিকার পাবে এবং বাদ পড়বে জরুরি প্রকল্প। এতে স্থানীয় স্তরে জনরোষ বা আইনশৃঙ্খলা সমস্যা হলে, তা জেলা প্রশাসনের পক্ষে সামলানো মুশকিল। তাই নতুন পদ্ধতিতে স্থানীয় পঞ্চায়েতকে কাজের বিষয়ে আগেভাগে অবদত করতেই সম্ভবত এই ভাবনা।
তবে এতে স্বচ্ছতা কতটা বজায় থাকবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধীরা। রাজ্য বিজেপির মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্যের প্রতিক্রিয়া, “জেলা পরিষদের টেন্ডার-ক্ষমতা না থাকলেও, সেখানকার ‘রাজনৈতিক প্রভুরা’ অফিসারদের উপরে নিজেদের প্রভাব বজায় রাখতেই পারেন।”
সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীর বক্তব্য, “এখন তো সবই দখলের পঞ্চায়েত। বখরায় সমস্যা হচ্ছিল নিশ্চয়ই।”