এ ভাবেই ওই যুগলের দেহ পড়ে থাকতে দেখেন স্থানীয়রা। —নিজস্ব চিত্র।
দেহ উদ্ধারের পর ৪ দিন কেটে গিয়েছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত রহস্যের কুলকিনারা হল না। হাওড়ার ডোমজুড়ের ওই যুগলকে ‘ পরিবারের সম্মান রক্ষার্থে খুন’ করা হয়েছে, নাকি এর নেপথ্যে রয়েছে অন্য কিছু, তা নিয়ে এখনও ধোঁয়াশা অব্যাহত। ময়নাতদন্ত না হওয়া পর্যন্ত এখনই কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছতে নারাজ পুলিশ। কিন্তু মৃতদেহ উদ্ধার থেকে গত কয়েক দিনের ঘটনাপ্রবাহে রহস্য ক্রমশ গাঢ় হচ্ছে। এ পর্যন্ত মোট ৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
অন্য় দিকে ডোমজুড়ে যুবকের দেহ নিয়ে এসে আরামবাগের মনসাতলায় রাস্তা অবরোধ করে এলাকাবাসী। আরমবাগ বন্দর রোডে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বিকেল পাঁচটা থেকে সারে সাতটা পর্যন্ত অবরোধ চলে। গ্রামবাসীদের অভিযোগ মেয়ের বাড়ির বিরুদ্ধে। তাঁদের বিরুদ্ধে পুলিশি ব্যবস্থা নেওয়া ও যুবকের মাকে ছাড়ার দাবিতে অবরোধ চলতে থাকে। সন্ধ্যায় পুলিশ অবরোধ তুলতে লাঠিচার্জ করে। গত ৯ ফেব্রুয়ারি ডোমজুড়ের নারনায় একটি নির্জন বাগানে স্থানীয়রাই প্রথম দেহ দু’টি পড়ে থাকতে দেখেন। তাঁরাই পুলিশে খবর দেন। স্থানীয়রা জানান, সেই সময় দু’টি দেহেই একাধিক গভীর ক্ষত দেখা গিয়েছিল, যা দেখে মনে হয়েছিল, ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানো হয় দু’জনকে। তার পর সেই ক্ষত পুড়িয়ে দেওয়া হয়। গোটা ঘটনায় চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে এলাকায়। খুন করে দেহ দু’টি সেখানে রেখে যাওয়া হয়েছে বলে জল্পনা শুরু হয়।
পুলিশি তদন্তে উঠে এসেছে, নিহত দু’জনই আরামবাগের মনসাতলা গ্রামের বাসিন্দা। ছেলেটির নাম অর্জুন দোলুই। তাঁর বয়স ২০-২১। মেয়েটির নাম রাখি প্রামাণিক। বয়স ১৫-১৬। একে অপরের প্রতিবেশী ছিলেন তাঁরা। দু’জনের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কিন্তু দুই পরিবারের কারও তাতে সম্মতি ছিল না। তাই পালিয়ে বিয়ে করেন দু’জনে। ঝামেলার ভয়ে বিয়ের পর গ্রামে না ফেরার সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা। সেই মতো ডোমজুড়ে একটি বাড়িতে আশ্রয় নেন। সেখানে থাকাকালীনই এই ঘটনা।
রাখির পরিবারের তরফে আগেই অর্জুনের বিরুদ্ধে থানায় অপহরণের অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল। তদন্তে নেমে অর্জুনের মাকে গ্রেফতার করে আরামবাগ থানার পুলিশ। তত ক্ষণে ডোমজুড় থানা থেকেও দু’জনের পরিচয় জানার চেষ্টা শুরু হয়ে গিয়েছে। আশপাশের থানা এবং অন্যান্য জেলার থানাতেও মৃতদের ছবি পাঠিয়ে খোঁজ নেওয়া হয়। ডোমজুড়ের যে বাড়িতে ওই যুগল আশ্রয় নিয়েছিলেন, সেখান থেকেও ৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়।
আরামবাগের যে এলাকার বাসিন্দা ওই যুগল, সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দারা গোটা ঘটনার যথাযথ তদন্তের দাবি তুলেছেন ইতিমধ্যেই। যদি দু’জনকে খুনই করা হয়ে থাকে, তাহলে খুনের পিছনে কী উদ্দেশ্য ছিল, এটা আসলে ‘পরিবারের সম্মান রক্ষার্থে খুন’ কি না, তা খতিয়ে দেখার দাবি জানান তাঁরা। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তেমন কোনও প্রমাণ মেলেনি বলে জানিয়েছে পুলিশ। হুগলির (গ্রামীণ) পুলিশ সুপার আমনদীপবলেন, ‘‘মেয়েটির বাড়ির তরফে যে অভিযোগ দায়ের হয়েছিল, তার ভিত্তিতেই ছেলেটির মাকে গ্রেফতার করা হয়। আরও ৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে প্রাথমিক ভাবে বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়েই দু’জনের মৃত্যু হয়েছে বলে মনে করছে পুলিশ।’’
আমনদীপের সংযোজন, ‘‘নারনায় বুনো শূকর জমির ফসল নষ্ট করে বলে জমির চারপাশে বিদ্যুতের বেড়া দিয়ে রাখেন স্থানীয়রা। কোনও ভাবে তা থেকে বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে দু’জনের। প্রথমে হয়তো মেয়েটি বিদ্যুৎপৃষ্ট হন, তাঁকে বাঁচাতে গিয়ে বিদ্যুৎপৃষ্ট হন ছেলেটিও। তবে এটা পুরোটাই অনুমান। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট এলেই মৃত্যুর আসল কারণ জানা যাবে।’’ ছেলের মা গ্রেফতার হয়েছে শুনে ডোমজুড়ের যে বাড়িতে ওই যুগল ভাড়া ছিলেন, সেখানকার লোকজনও পালানোর চেষ্টা করেন বলে জানিয়েছেন তিনি। কিন্তু ওই বাড়ির সদস্যরা মৃতদের পূর্ব পরিচিত কি না, তা খোলসা করেননি তিনি।
এমনকি বাড়ি ছেড়ে বিদ্যুতের বেড়ার কাছে যাওয়ার প্রয়োজনই বা পড়ল কেন ওই যুগলের, সদুত্তর মেলেনি তারও। আবার ধারাল অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে খুন করলে যে ভাবে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকার কথা দেহ দু’টির, এক্ষেত্রে তার উল্টোটা ঘটেছে বলেই অনুমান স্থানীয়দের একাংশের। দু’জনের কারও জামাকাপড়ে রক্তের ছিটোফোঁটাও ছিল না। বাগানের যে জায়গা থেকে দেহ দু’টি উদ্ধার হয়, সেখানেও রক্তের দাগ মেলেনি। সব মিলিয়ে যে কারণে মৃত্যুর কারণ নিয়ে বাড়ছে ধোঁয়াশা।