তাহিদুর রহমান মণ্ডল
ফুটফুটে সব মুখ। কিন্তু শরীরের নীচের অংশ থেকে মাংসপেশি অকেজো হতে শুরু করেছে। একদিন হয়তো হৃদযন্ত্রের মাংসপেশিও কাজ করা বন্ধ করে দেবে। সব জেনেও কিছু করার নেই। কারণ, মাসকুলার ডিসট্রফির মতো মারণ রোগের কোনও ওষুধ এখনও সে ভাবে নেই।
এই নিকষ অন্ধকারের মধ্যেই পাঁচ বছরের অমৃক, আট বছরের মুগ্ধ, নয় বছরের তাহিদুর, চোদ্দো বছরের সোমঋকদের পাশে দাঁড়িয়েছে স্বাস্থ্য দফতর। মাসকুলার ডিসট্রফিতে আক্রান্ত এই শিশু-কিশোরদের জিনভিত্তিক থেরাপির ক্লিনিকাল ট্রায়াল চালু করার আইনি
প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এ ব্যাপারে মডেল করা হয়েছে আমেরিকার ‘ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনস্ট্রেশন’ বা এফডিএ-র কাজ।
কী রকম? চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্তারা জানাচ্ছেন, গোটা পৃথিবী জুড়েই মাসকুলার ডিসট্রফি-র কোনও ওষুধ সে ভাবে নেই। এফডিএ কিছু রোগীর উপর পরীক্ষামূলক ভাবে একটি বিশেষ থেরাপি প্রয়োগ করেছিল। সেই ট্রায়ালের ভিত্তিতে ‘এগজনডিজ ৫১’ নামে একটি ইঞ্জেকশন গত সেপ্টেম্বরে আমেরিকার বাজারে আসে। এর কার্যকারিতা এখনও ১০০ শতাংশ প্রমাণিত নয়। কিন্তু রোগীদের কথা মাথায় রেখে ইঞ্জেকশনটির বিক্রি শুরু হয়েছে। শর্ত হল, এটা কতটা ফলদায়ী হচ্ছে তার রিপোর্ট এফডিএ-কে জানাতে থাকবে ইঞ্জেকশন প্রস্তুতকারী সংস্থা।
এই খবরটা জানার পরে পশ্চিমবঙ্গে মাসকুলার ডিসট্রফিতে আক্রান্ত প্রায় ১০০ শিশু-কিশোরের অভিভাবকদের একটি সংগঠন গত ২০ ফেব্রুয়ারি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে একটি চিঠি দেয়। মুখ্যমন্ত্রীকে তাঁরা অনুরোধ করেন, আমেরিকার মতো এ রাজ্যেও মাসকুলার ডিসট্রফির রোগীদের উপর পরীক্ষামূলক থেরাপি চালানো হোক। মুখ্যমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সেই মতো নির্দেশ যায় স্বাস্থ্যভবনে।
মাসকুলার ডিসট্রফি কী?
•এক ধরনের জিনঘটিত রোগ যাতে শুধু ছেলেরা আক্রান্ত হয়। এতে একটি-একটি করে শরীরের মাংসপেশী অকেজো হয়ে যেতে থাকে।
•১৯৯৭ সালের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতে নথিভুক্ত রোগী ২২ হাজার। প্রতিবছর নতুন করে নথিভুক্ত ২৫০০ রোগী।
•২০১০-এর একটি সমীক্ষা, ভারতে প্রতি ৩৫০০ জনের ভিতর এক জনের এই রোগ হয়।
স্বাস্থ্য দফতর তিন সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে। বাঙুর ইনস্টিটিউট অব নিউরোলজির বিভাগীয় প্রধান শ্যামল দাস ওই কমিটির মাথায় ছিলেন। সম্প্রতি তাঁরা রিপোর্ট দিয়েছেন, ‘উন্নত জেনেটিক ল্যাবরেটরিযুক্ত সরকারি হাসপাতালে ক্লিনিকাল ট্রায়াল করা যেতে পারে। এ জন্য ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থার সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন।’ রিপোর্টটি গত মাসে জমা পড়েছে স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিকর্তা দেবাশিস ভট্টাচার্যর কাছে। দেবাশিসবাবু বলেন, ‘‘ঠিক হয়েছে, প্রথমে ২২ জনের উপর এই ট্রায়াল হবে। এর জন্য রাজ্যের তরফ থেকে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক ও কেন্দ্রীয় ড্রাগ কন্ট্রোলে আবেদন করা হচ্ছে।’’
আরও পড়ুন:নীল তিমির আড়ালে জাল পেতে চোর
রাজ্য সরকার আশাবাদী, এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় অনুমতি পেতে সমস্যা হবে না। বিষয়টি সম্পর্কে অবগত আছেন কেন্দ্রীয় সরকারের পূর্বাঞ্চলের ফার্মাকো-ভিজিল্যান্স কমিটির প্রধান শান্তনু ত্রিপাঠী। তাঁর কথায়, ‘‘ওঁরা যেটা করতে চাইছেন সেটা হল রোগী ভিত্তিক থেরাপির ট্রায়াল। অর্থাৎ রোগীদের রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে উন্নত জিন-ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে প্রয়োজনমাফিক বায়োলজিকাল সাবস্ট্যান্স প্রয়োগ করা। তাতে আইনত অসুবিধা নেই।’’
ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চ-এর কর্ণধার সৌম্যা স্বামীনাথন জানাচ্ছেন, ‘‘বিরল ওষুধের ক্ষেত্রে কোনও রাজ্য ক্লিনিকাল ট্রায়ালের আবেদন করলে কেন্দ্র ফাস্ট ট্র্যাক ভিত্তিতে অনুমতি দিতেই পারে। সে ক্ষেত্রে আর আলাদা করে আইসিএমআর-এর অনুমতি দরকার হবে না।’’
গত ২৪ অগস্ট নিজের বাড়িতে অভিভাবকদের ডেকে কথা বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। অভিভাবকেরাই জানিয়েছেন, ফাস্ট ট্র্যাক পদ্ধতিতে যাতে ট্রায়াল হয়, তার প্রক্রিয়া শুরুর আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। অভিভাবকরা খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরেছেন আশার আলোটুকুই। নির্মাল্য রায় যেমন বললেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী নিজে উদ্যোগী হলেন বলেই আমরা একটা শেষ চেষ্টা করার সুযোগ পাচ্ছি।’’