প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই বোমা ফাটিয়েছেন তিনি। ‘নিয়ম ভেঙে’ তৃতীয় বারের জন্যেও ভোটে লড়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি। তবে কি এ বার ক্ষমতা ধরে রাখতে সংবিধানের আমূল বদল ঘটাবেন ‘সুপার পাওয়ার’ দেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা?
সদ্য শেষ হওয়া আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ভোটে বিরাট ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। আগামী বছরের (পড়ুন ২০২৫ সাল) জানুয়ারিতে ৪৭তম রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে শপথ নিয়ে রাজধানী ওয়াশিংটনের ‘শ্বেত প্রাসাদ’-এ (হোয়াইট হাউস) পা রাখবেন তিনি। কিন্তু, তার আগেই রিপাবলিকান নেতার একটি মন্তব্য ঘিরে দুনিয়া জুড়ে তোলপাড় পড়ে গিয়েছে।
চলতি বছরের ১৩ নভেম্বর ওয়াশিংটনের একটি হোটেলে আমেরিকার আইনসভার (যাকে কংগ্রেস বলা হয়) নিম্নকক্ষ হাউস অফ রিপ্রেজ়েন্টেটিভসের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করেন ট্রাম্প। তাঁদের সামনে দাঁড়িয়েই তিনি জানান, সমর্থকেরা চাইলে তৃতীয় বার প্রেসিডেন্ট হতেও কোনও আপত্তি নেই তাঁর। এর পরই আমেরিকার সংবিধান বদল নিয়ে জল্পনা শুরু হয়ে যায়।
এ প্রসঙ্গে ঠিক কী বলেছেন আমেরিকার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট? ট্রাম্পের কথায়, ‘‘আমার ধারণা, আমি আর প্রেসিডেন্ট ভোটে লড়ব না। তবে যদি আপনারা বলেন যে, ‘তিনি ভাল ছিলেন’, কিংবা ‘বিশেষ একজনকে আমরা পেয়েছি’, তা হলে আলাদা কথা।’’ তাঁর এই মন্তব্যের পর রিপাবলিকান দলের অন্দরেও জলঘোলা শুরু হয়ে গিয়েছে।
আমেরিকার সংবিধান অনুযায়ী, কোনও ব্যক্তি দু’বারের বেশি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পারেন না। অর্থাৎ, রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে সর্বোচ্চ আট বছর ক্ষমতায় থাকতে পারবেন তিনি। ২০১৬ এবং ২০২৪ সালে প্রেসিডেন্ট ভোটে জিতেছেন ট্রাম্প। ফলে ২০২৮ সালের নির্বাচনে লড়তে হলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে তাঁকে।
এখন থেকে প্রায় ২৩৫ বছর আগে, ১৭৮৯ সালের ৪ মার্চ কার্যকর হয় আমেরিকার সংবিধান। যা বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন সংবিধান হিসাবে পরিচিত। পরবর্তী সময়ে একাধিক বার তাতে সংশোধনী আনা হয়েছে। যার মধ্যে ২২তম সংশোধনী খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
যুক্তরাষ্ট্রে সংবিধান গৃহীত হওয়ার সময়ে কোনও ব্যক্তির প্রেসিডেন্ট হিসাবে কার্যকালের মেয়াদ কত বছর হবে, তা স্পষ্ট ছিল না। ফলে দু’বার নির্বাচিত হওয়ার পরও ভোটে লড়ার অধিকার ছিল রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের। ১৯৫১ সালে অনুমোদিত ২২তম সংশোধনীতে এই নিয়মের বদল করা হয়।
ওই সংশোধনীতেই কোনও ব্যক্তি তৃতীয় বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পারবেন না বলে উল্লেখ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কেন্দ্রীয় আইনসভা বা কংগ্রেসের অবিচ্ছেদ্য অংশ নন। ফলে বেশ কিছু ক্ষেত্রে ‘একক সিদ্ধান্ত’ গ্রহণের ক্ষমতা রয়েছে তাঁর। যার অপব্যবহার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর তাই ওই সংশোধনী আনা হয় বলে মনে করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গবেষকেরা।
ব্রিটেনের হাত থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পর আমেরিকার প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন জর্জ ওয়াশিংটন। তিনি এবং তৃতীয় প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসন কখনওই দু’বারের বেশি ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি। ফলে এই নিয়ম একটা প্রথায় পরিণত হয়েছিল। ২২তম সংশোধনীতে যাকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক নেতৃত্ব।
ওয়াশিংটনের সময় থেকে চলে আসা ওই নিয়ম অবশ্য ভেঙে দেন ফ্র্যাঙ্কলিন ডেলানো রুজভেল্ট। মোট চার বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৩৩ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত টানা ১২ বছর ক্ষমতায় ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় এই রাজনৈতিক নেতা।
প্রথম দু’টি মেয়াদে (১৯৩৩-১৯৩৭ এবং ১৯৩৭-১৯৪১) বিশ্বব্যাপী মহামন্দার মুখোমুখি হন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট। ১৯৪০ ও ১৯৪৪ সালের ভোটে সব হিসাবকে চমকে দিয়ে তৃতীয় ও চতুর্থ বার জিতে যান তিনি। তবে প্রেসিডেন্ট হিসাবে চতুর্থ মেয়াদ পুরোপুরি শেষ করতে পারেননি তিনি। ১৯৪৫ সালে ক্ষমতায় থাকাকালীনই মৃত্যু হয় তাঁর। রুজভেল্টের স্থলাভিষিক্ত হন হ্যারি ট্রুম্যান।
এর পরই সংবিধান সংশোধনী এনে প্রেসিডেন্টের কার্যকালের মেয়াদ সর্বাধিক আট বছরে আটকে দেন রাজনৈতিক নেতৃত্ব। এই আইন বদল করা মোটেই সহজ নয়। আর তাই ট্রাম্পের তৃতীয় বারের জন্য শ্বেত প্রাসাদে যাওয়ার স্বপ্ন কতটা সফল হবে, তা নিয়ে সন্দিহান আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা।
যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান সংশোধন করার দু’টি উপায় রয়েছে। এর জন্য প্রথমেই কংগ্রেসের দুই কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন লাগবে। অর্থাৎ, নিম্নকক্ষ হাউস অফ রিপ্রেজ়েন্টেটিভসের ২৯০ এবং উচ্চকক্ষ সেনেটের ৬৭ জন সদস্যকে সংশোধনী বিল পাশ করার ব্যাপারে সম্মত হতে হবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে তিন-চতুর্থাংশ রাজ্যের সমর্থন পেতে হবে। অর্থাৎ, কমপক্ষে ৩৮টি রাজ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকতে হবে ট্রাম্পের দল রিপাবলিকানদের।
এ বছরের ভোটে ১৭টি রাজ্য ট্রাম্পের মূল প্রতিপক্ষ ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেত্রী তথা ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের পক্ষে ভোট দিয়েছে। তা ছাড়া সংবিধানের এই নিয়মের পরিবর্তন করা নিয়ে রিপাবলিকান দলের নেতা-নেত্রীদের মধ্যেও দ্বিমত রয়েছে। ফলে সংশোধনী বিল আনলে ট্রাম্প কতটা সমর্থন পাবেন, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।
সংবিধানের ২২তম সংশোধনী পাল্টে দিতে ট্রাম্পের হাতে আরও একটি উপায় রয়েছে। সে ক্ষেত্রে সাংবিধানিক কনভেনশন ডাকতে হবে তাঁকে। যাকে দুই-তৃতীয়াংশ রাজ্য সমর্থন করবে। অর্থাৎ, কমপক্ষে ৩৪টি রাজ্যের সমর্থন পেতে হবে। এর পর তিন-চতুর্থাংশ রাজ্যের (কমপক্ষে ৩৮টি রাজ্য) অনুমোদন পেলে ওই কনভেশনে সংবিধান সংশোধনী বিল পাশ করা যাবে।
বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলেছেন আমেরিকার আইন বিশেষজ্ঞ ম্যাককনেল। তাঁর কথায়, ‘‘তাত্ত্বিক দিক থেকে ট্রাম্পের পক্ষে সংবিধান সংশোধন করে তৃতীয় বারের জন্য নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা কঠিন। জোর করে আইন ভেঙে সব কিছু করতে গেলে তিনি মূর্খামির পরিচয় দেবেন।’’
আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, সংবিধানের ২২তম সংশোধনী বাতিল করার ক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টেরও নেই। ক্যালিফোর্নিয়া লস অ্যাঞ্জেলস বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক অ্যাডাম উইঙ্কলারের মত, বর্তমান পরিস্থিতিতে সংবিধান সংশোধন করা খুবই চ্যালেঞ্জের। এতে সংখ্যা ও নৈতিকতা দুই ফ্রন্টে লড়তে হবে ট্রাম্পকে।
এই সব আইনি জটিলতা নিয়ে অবশ্য মাথা ঘামাতে নারাজ নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। জানুয়ারিতে শপথের আগে নিজের ‘কিচেন ক্যাবিনেট’ সাজিয়ে নিচ্ছেন তিনি। আপাতত আমেরিকাকে ‘মহান রাষ্ট্রে’ পরিণত করার পণ নিয়েছেন ট্রাম্প। চার বছর শেষে ফের নির্বাচনে লড়তে সংবিধান সংশোধনী আনবেন কি না, তার জবাব দেবে সময়।