ফাঁসির সাজা প্রাপ্ত সনাতন ওঝা এহং মঙ্গলা কলকাতা হাই কোর্টে আবেদন করেন। গ্রাফিক— শৌভিক দেবনাথ।
পুরুলিয়ায় সুচ ফুটিয়ে শিশুকে হত্যার ঘটনায় দোষীদের মৃত্যুদণ্ডের নির্দেশ রদ করল কলকাতা হাই কোর্ট। বদলে দোষীদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়ে হাই কোর্টের দুই বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়েছে, ৩০ বছর পর্যন্ত জামিনের জন্য আবেদন করতে পারবেন না দোষীরা।
পুরুলিয়ার ওই ঘটনায় এক সাড়ে তিন বছরের শিশুকন্যার মৃত্যু হয়েছিল। অভিযোগ ছিল, শিশুটির মা এবং এক স্থানীয় ওঝা শিশুটির শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে, এমনকি যৌনাঙ্গেও সুচ বিধিয়ে তার উপর অত্যাচার চালানো হয়েছিল। যার জেরে গুরুতর অসুস্থ হয়ে মৃত্যু হয় শিশুটির। জেলা আদালতে এই ঘটনায় নিহত শিশুর মা মঙ্গলা গোস্বামী এবং ওঝা সনাতন গোস্বামী (ঠাকুর)কে দোষী সাব্যস্ত করে। পুরুলিয়ার আদালত তাঁদের ফাঁসির সাজাও দেয়। বৃহস্পতিবার সেই নির্দেশই রদ করল কলকাতা হাই কোর্ট।
দোষীরা জেলা আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আবেদন করেছিলেন কলকাতা হাই কোর্টে। বৃহস্পতিবার বিচারপতি দেবাংশু বসাক এবং বিচারপতি বিভাসরঞ্জন দে-র ডিভিশন বেঞ্চে উঠেছিল মামলাটি। তাঁরাই দোষী মঙ্গলা এবং সনাতনের ফাঁসির সাজা রদ করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। সেই সঙ্গে জানিয়ে দেন, দোষীরা জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আগামী ৩০ বছর পর্যন্ত জামিনের আবেদন করতে পারবেন না।
২০১৭ সালের এই ঘটনায় শোরগোল পড়ে গিয়েছিল সমাজের বিভিন্ন মহলে। সাড়ে তিন বছরের শিশুটির মৃত্যু তো বটেই, সুশীল সমাজকে যা চমকে দিয়েছিল, তা হল শিশুটির উপর শারীরিক অত্যাচারের বিশদ বিবরণ। হাসপাতালে এক্সরে-তে দেখা গিয়েছিল, শিশুটির শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে সাতটি সুচ ফুটে রয়েছে। পরে ময়নাতদন্তেও জানা যায়, শিশুটির পাঁজরে, তলপেটে ও যৌনাঙ্গে সুচ ফোটানো হয়েছিল। যার জেরে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে শিশুটি। এবং তাঁকে অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করার ন’দিনের মধ্যেই তার মৃত্যু হয়।
এই ঘটনায় নড়েচড়ে বসে পুলিশ। ঘটনায় জড়িত অভিযোগে ২০১৭ সালের ২২ জুলাই মঙ্গলাকে গ্রেফতার করা হয়। মূল অভিযুক্ত তথা পলাতক সনাতনকে গ্রেফতার করা হয় উত্তরপ্রদেশের সোনভদ্র জেলায় এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে। পরে তদন্তে প্রকাশ্যে আসতে থাকে একের পর এক তথ্য। পুলিশ জানতে পারে পেশায় ওঝা সনাতন একজন অবসরপ্রাপ্ত হোম গার্ড। আরও জানা যায়, নিহত শিশুকন্যাটির মায়ের প্রেমিকও। তাঁর কথাতেই চালানো হয় শিশুটির উপর অত্যাচার। এর পরই দু’জনের বিরুদ্ধে ‘প্রোটেকশন অব চিলড্রেন ফ্রম সেক্সুয়াল অফেন্সেস’ (পকসো)-সহ ভারতীয় দণ্ডবিধির একাধিক ধারায় মামলা শুরু করে পুলিশ।
ঘটনার ৫৭ দিনের মাথায় ২০১৭ সালের ১২ সেপ্টেম্বর চার্জশিট পেশ করা হয়। পুলিশের পেশ করা তথ্যপ্রমাণ ও সাক্ষীদের বয়ানের ভিত্তিতেই সাজা দেয় পুরুলিয়ার জেলা আদালত। সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে কলকাতা হাই কোর্টে মামলা করা হয়। তারই রায় দান হল বৃহস্পতিবার।
রাজ্যের আইনজীবী সঞ্জয় বর্ধন বলেন, "এটি একটি বিরলতম ঘটনা। গোটা সমাজ এই ঘটনায় ব্যথিত হয়েছে। সেই কারণে এই ঘটনায় মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মূলত তিনটি বিষয়ের উপর দাঁড়িয়ে উচ্চ আদালত মৃত্যুদণ্ড রদ করে। এক, সুপ্রিম কোর্টের একটি পর্যবেক্ষণে জানিয়েছে, ক্ষেত্র বিশেষে তরুণ এবং বৃদ্ধদের মৃত্যুদণ্ড থেকে ছাড় দেওয়া যেতে পারে। দুই, এই দুই জনের নামে আগে কোনও অপরাধমূলক মামলা নেই। তিন, জেলে থাকাকালীন এঁরা ভাল আচরণ করেছে।"