পিকনিকের দাপটে নির্জনতা খানখান। সংস্কারের অভাবে পানায় মজে যাচ্ছে জলাশয়। সেই সঙ্গে নৌকা নিয়ে দিনভর নদী-বিল দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন পর্যটকেরা। গুলতি হাতে চোরাশিকারা তো আছেই। তাই উত্তরবঙ্গের প্রথম সারির চারটি জলাশয় থেকে মুখ ফিরিয়েছে নানা প্রজাতির ভিন্দেশি হাঁস। বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের নারারথলি, কোচবিহারের রসিকবিল, জলপাইগুড়ির গজলডোবা ও শিলিগুড়ির উপকণ্ঠের ফুলবাড়িতে পাখি-শুমারির শেষে এমনই তথ্য সামনে এসেছে।
হিমালয়ান নেচার অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশনের (ন্যাফ) উদ্যোগে বন দফতরের সহায়তায় ওই পাখি-শুমারি হয়। ন্যাফের কোঅর্ডিনেটর অনিমেষ বসুর কথায়, ‘‘বছর দশ-পনেরো আগে যত পরিযায়ী পাখি উত্তরের ওই জলাশয়ে আসত, তার সংখ্যা কমছে। বন দফতরের পক্ষে একা এটা রোখা সম্ভব নয়।’’ তাঁর কথায়, পুলিশ-প্রশাসন-পঞ্চায়েত-স্বেচ্ছাসেবী-জন প্রতিনিধিদের একযোগে আসরে নামতে হবে। না হলে পরিযায়ীরা আগামী দিনে হয়তো আসবেই না। বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের ক্ষেত্র অধিকর্তা উজ্জ্বল ঘোষও উদ্বিগ্ন। তিনিও বলেন, ‘‘বেশ কয়েকটি প্রজাতির ভিন্দেশি পরিযায়ী হাঁস এ বার আসেনি। আরও কয়েকটি জলচর পাখির দেখা মেলেনি এ বার।’’ তবে তিনি জানিয়েছেন, পরিযায়ী পাখিরা যাতে নিরাপদে শীতকালটা এখানে কাটাতে পারে সে জন্য সব রকম সতর্কতা নিতে হবে।
ন্যাফ ও বন দফতর সূত্রেই জানা গিয়েছে, বছর পনেরো আগেও উত্তরবঙ্গের জলাশয়ে শীতের শুরুতেই যথেষ্টই দেখা মিলত সেই বৈকাল হাঁস, ছোট লালশির, নীরশির, বড় রাঙামুড়ি, বড় দিঘর, পাতারি হাঁসের। রকমারি চিল, বাজের দেখাও মিলত জলাশয়ের আশেপাশের গাছে। কিন্তু, চলতি শীতে পাখি-গণনার সময়ে নারারথলিতে সামান্য কিছু ভিন্দেশি মেটে হাঁস দেখা গিয়েছে। প্রায় এক দশক পরে রসিকবিলে দেখা গিয়েছে এক জোড়া শঙ্খচিল। বহু দিন বাদে গজলডোবায় দেখা গিয়েছে মাত্র একটি ‘বিন গুজ’। তাকে নিয়ে তাই হইচইয়ের অন্ত নেই।
পাখি-শুমারি ১৫ বছর আগে ও এখন
• বক্সার নারারথলিতে ছিল ২০০০, এখন ১১০০। প্রজাতি ছিল ৪২টি, এখন ৩০।
• রসিকবিলে ছিল ৯০০০টি, এখন ৩২০০। প্রজাতি ছিল ৬০, এখন ৪৬।
• ফুলবাড়ি ক্যানালে ছিল ৬০০০, এখন ৫৪০০। প্রজাতি ছিল ৭৪টি, এখন ৬৩।
• গজলডোবা তিস্তা বাঁধে ছিল ১৫০০০, এখন ৭৫০০। প্রজাতি ছিল ৬৫, এখন ৫৮।
(আনুমানিক গড় হিসেবের সূত্র ন্যাফ ও বন দফতর)
ফুলবাড়িতে অবশ্য পানকৌড়ির ভিড়ই বেশি। তবে সমীক্ষায় ধরা পড়েছে, গত দু-তিন বছরের তুলনায় ফুলবাড়িতে এ বার পাখির সংখ্যা বেশি। নারারথলি, ফুলবাড়ি, গজলডোবায় কড়াকড়ি ইদানীং বেড়েছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও আসরে নামায় জলাশয়ে হাঙ্গামা তুলনায় কম।
সব চেয়ে দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে রসিকবিল। সেখানে সমীক্ষকরা দেখেছেন, পানায় মজে গিয়েছে জলাশয়। আনুপাতিক হারে পানা পরিষ্কার না করালে পরিযায়ীদের বিচরণে খুব অসুবিধে হয়। এ ছাড়াও ফাঁস জাল দিয়ে মাছ ধরা চলছে বলে অভিযোগ। তাতে আটকে পড়ছে বহু পাখি।
পরিবেশপ্রেমী সংস্থা ন্যাস গ্রুপের সম্পাদক অরূপ গুহ বলেন, “পরিয়ায়ী পাখিদের জন্যই রসিকবিলকে পাখিরালয় হিসাবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা শুরুতে নেওয়া হয়েছিল। সেখানে যথেচ্ছ ভাবে ক্রংক্রিটের ঘরবাড়ি তৈরি ঠিক হয়নি। পিকনিক, সঠিক ভাবে জলাশয় দেখভাল না হওয়ায় পাখিরা বিপন্ন।”
রসিকবিলটি পশ্চিমবঙ্গ বন উন্নয়ন নিগমের আওতায় রয়েছে। নিগমের চেয়ারম্যান উদয়ন গুহ ক’দিন আগেই রসিকবিলে গিয়ে সরেজমিনে সব দেখেছেন। তিনি বলেন, ‘‘ওখানে অল্প সংখ্যক পাখি দেখেছি।’’ তিনি জানান, কলকাতায় দফতরের কর্তাদের সঙ্গে ওই ব্যাপারে আলোচনা করেছেন। বনমন্ত্রী বিনয়কৃষ্ণ বর্মনও পরিযায়ীদের নিরাপত্তা বাড়াতে বৈঠকে বসবেন বলে জানিয়েছেন।