রাস্তা আটকে বিক্ষোভ স্থানীয় বাসিন্দাদের। (ইনসেটে) সঞ্জয় প্রামাণিক। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।
গত জুলাই মাসে মেদিনীপুর সফরে এসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রীর যাত্রাপথ নির্বিঘ্ন করতে নতুনবাজার-জজকোর্ট রোড রাস্তার সব হাম্প তুলে দেওয়া হয়েছিল। হাম্প সরানো হয়েছিল জুগনুতলার কাছেও। কথা ছিল, মুখ্যমন্ত্রীর সফরের পর ফের হাম্প তৈরি করে দেওয়া হবে। কিন্তু তা হয়নি। রবিবার রাতে জুগনুতলার কাছেই বাসের ধাক্কায় মৃত্যু হল সাইকেল আরোহী এক যুবকের। স্থানীয়দের দাবি, হাম্প থাকলে এই দুর্ঘটনা এড়ানো যেত। হাম্প তৈরির দাবিতে সোমবার সকালে এলাকায় পথ অবরোধও করেন বাসিন্দারা। অবরোধের জেরে শহরের গুরুত্বপূর্ণ এই রাস্তায় যান চলাচল ব্যাহত হয়। পুলিশের মধ্যস্থতায় অবরোধ ওঠে।
মেদিনীপুর শহরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা নতুনবাজার-জজকোর্ট রোড। এটি শহরের অন্যতম প্রবেশপথও বটে। মুখ্যমন্ত্রীর সফরের পরও কেন ভেঙে ফেলা হাম্পগুলি নতুন করে তৈরি করা হল না, এ দিন সেই প্রশ্ন তুলেই সরব হন স্থানীয়রা। এলাকার বাসিন্দা রতন চক্রবর্তী, সৌমেন পালদের কথায়, “রাস্তা দিয়ে দ্রুত গতিতে গাড়ি চলাচল করে। হাম্প থাকলে তা হত না। দুর্ঘটনাও কমত।”
ঠিক কী ভাবে ঘটল দুর্ঘটনা?
রবিবার রাত আটটা নাগাদ স্থানীয় কালীমন্দিরে পুজো দিয়ে জুগনুতলাচকের দিকে সাইকেলে যাচ্ছিলেন বছর আঠাশের সঞ্জয় প্রামাণিক ওরফে সঞ্জু। জুগনুতলার কাছে জজকোর্ট রোডগামী বরযাত্রী বোঝাই একটি বাস পিছন থেকে তাঁকে ধাক্কা মারে। সাইকেল থেকে ছিটকে পড়েন সঞ্জু। বাসের পিছনের চাকা তাঁকে পিষে দিয়ে চলে যায়। স্থানীয়রাই উদ্ধার করে আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাঁকে মেদিনীপুর মেডিক্যালে ভর্তি করান। পরে সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। ঘটনার পরে জুগনুতলার কাছে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
মৃত যুবকের বাড়ি মহাতাবপুর দক্ষিণপাড়ায়। সঞ্জুর বাবা নিমাই প্রামাণিক বলেন, “ছেলে মন্দিরে দেওয়ার পর জুগনুতলাচকের দিকে যাচ্ছিল। তখনই একটি বাস পিছন থেকে ধাক্কা মারে। কোথা থেকে কী হয়ে গেল বুঝতে পারছি না।” দুর্ঘটনার পর স্থানীয়রা বাসটিকে আটকান। পুলিশ এসে চালক লক্ষ্মীকান্ত মাইতিকে গ্রেফতার করে। বাসটিকেও আটক করা হয়। শহরের কাউন্সিলর সৌমেন খানের কথায়, “হাম্প তুলে দেওয়ায় এই রাস্তায় দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়ছে।” আর এক কাউন্সিলর কৌস্তভ বন্দ্যোপাধ্যায়ও বলেন, “অবিলম্বে হাম্প তৈরি করা দরকার।” একই মত জুগনুতলা এলাকার কাউন্সিলর হিংমাশু মাইতির। তাঁর কথায়, “হাম্প না থাকায় মাঝেমধ্যে দুর্ঘটনা ঘটছে।”
এই রাস্তাটি পূর্ত দফতরের অধীন। স্থানীয়দের বক্তব্য, পুর-কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল, পূর্ত দফতরের সঙ্গে কথা বলে হাম্প তৈরির ব্যবস্থা করা। উপ-পুরপ্রধান জিতেন্দ্রনাথ দাস অবশ্য বলেন, “হাম্প পূর্ত দফতর তুলেছে। পূর্ত দফতরই তৈরি করবে।” পূর্ত দফতরের এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার গৌতম শেঠের কথায়, “প্রশাসনিক অনুমতি মিললে হাম্প তৈরি করে দেওয়া হবে।” আর মেদিনীপুরের (সদর) মহকুমাশাসক অমিতাভ দত্ত বলেন, “পূর্ত দফতরকে হাম্প তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”
মেদিনীপুরে যানজট সমস্যা নতুন নয়। শহরে আলাদা করে ফুটপাথ নেই। অগত্যা রাস্তা দিয়েই হাঁটতে হয়। দু’পাশে দোকান হয়ে যাওয়ায় রাস্তাও সংকীর্ণ হচ্ছে। শহরের গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলোর মধ্যে নতুনবাজার-জজকোর্ট রোড, জজকোর্ট রোড-কেরানিতলা, কেরানিতলা-কালেক্টরেট মোড়, কালেক্টরেট মোড়-গাঁধী স্ট্যাচু মোড়, গাঁধী স্ট্যাচু মোড়-বটতলা চক, বটতলা চক-কেরানিতলা, গোলকুয়া চক-ধর্মা অন্যতম। গোলকুয়া চক-ধর্মা রাস্তাটি সবথেকে বেশি দুর্ঘটনাপ্রবণ। স্থানীয় বাসিন্দা আইনজীবী তীর্থঙ্কর ভকতের কথায়, “গত দশ বছরে এখানে দুর্ঘটনায় ২৩ জন মারা গিয়েছেন। ১৯ জন জখম হয়েছেন। রাস্তাটি ওয়ান-ওয়ে হওয়ার কথা। কিন্তু দুর্ঘটনা এড়াতে কোনও ব্যবস্থাই নেওয়া হচ্ছে না।” এক সময় প্রশাসনিক বৈঠকে ঠিক হয়েছিল, সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা এবং বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত শহরের মধ্যে বড় লরি ঢুকতে পারবে না। তারপরেও পুলিশি নজরদারি ফাঁক গলে শহরে বড় লরি ঢোকেই।
জেলা পুলিশের এক কর্তার আশ্বাস, “শহরে দ্রুত গতিতে গাড়ি চলাচল বন্ধে নজরদারি চলেই। তা আরও বাড়ানো হবে। শহরের কিছু রাস্তাও চওড়া করা প্রয়োজন। না- হলে আগামী দিনে সমস্যা হবে।” পুরসভার এক কর্তা বলেন, “শহরে রাস্তা চওড়া করার ক্ষেত্রে বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে। সবটাই আমাদের জানা। কিন্তু, অনেক সময় কিছু করার থাকে না! ” নজরদারি আর উদ্যোগের অভাবে মৃত্যুফাঁদে পরিণত হবে না তো রাস্তাগুলো! পথ দুর্ঘটনায় সাইকেল আরোহী যুবকের মৃত্যু এই প্রশ্নটাই তুলে দিয়ে গিয়েছে।