১৯৭৯ সাল। সূর্যকান্ত মিশ্র তখন অবিভক্ত মেদিনীপুরের জেলা সভাধিপতি। —ফাইল চিত্র।
সময়টা আশির দশকের মাঝামাঝি। নারায়ণগড়-সবংয়ের বিস্তীর্ণ এলাকা জলের তলায়। সূর্যকান্ত মিশ্র তখন অবিভক্ত মেদিনীপুরের জেলা সভাধিপতি। নৌকায় চেপে বন্যা পরিদর্শনে বেরিয়েছিলেন। আচমকা ঝোড়ো হাওয়ায় নৌকা টলমল। পাশে বসা এক সহযাত্রীর চোখমুখ দেখে সূর্যবাবু জানতে চেয়েছিলেন, ‘ভয় করছে? সাঁতার জানো?’ গোড়ায় খানিক থতমত খেয়ে গিয়েছিলেন ওই সহযাত্রী। পরে সামলে বলেছিলেন, ‘জানি, আপনি?’ নারায়ণগড়ের বিধায়কের উত্তর ছিল, ‘শীতের রাতে সাঁতরে মহানদী পার হয়েছি। এ আর এমন কী জল!’
এহেন সূর্যবাবুর কাঁধে এখন ক্ষয়িষ্ণু সিপিএমের ভার। সহকর্মীরা পুরনো কথা মনে করে জোর গলায় বলছেন, শীতের রাতে তিনি মহানদী সাঁতরে পেরিয়েছেন, সিপিএমের এমন দুর্দিনে রক্তক্ষরণ ঠেকাতে পারবেন তিনিই!
সহকর্মীরা আরও বলছেন, সূর্যবাবু কখনও-সখনও মচকান। তবু ভাঙেন না! রাজ্যে একের পর এক নির্বাচনে সিপিএমের বিপর্যয় অব্যাহত। সময়টা যে কঠিন, তা মানেন নেতৃত্বও। এই কঠিন সময়ই দলের দায়িত্ব পেলেন সূর্যবাবু। শুক্রবারই তিনি রাজ্য সিপিএমের সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। নারায়ণগড়ের বিধায়ক রাজ্যে দলের প্রধান মুখ হওয়ায় খুশি পশ্চিম মেদিনীপুরের সিপিএম নেতা-কর্মী- সমর্থকেরাও। তাঁরা বিশ্বাস করেন, ধারাবাহিক রক্তক্ষরণের রোগে আক্রান্ত দলকে আলো দেখাবেন এই চিকিৎসকই।
বছর তিনেক আগেই দলের পলিটবুর্যো সদস্য হয়েছিলেন। এ বার রাজ্য সম্পাদক। শুরু থেকে চলার পথটা অবশ্য মসৃন ছিল না। বহু চড়াই-উতরাই পেরোতে হয়েছে সূর্যবাবুকে। বাড়ি নারায়ণগড়ের খাকুড়দায়। ছাত্র জীবন থেকে রাজনীতিতে হাতেখড়ি। পড়াশোনা খাকুড়দার বড়মোহনপুর হাইস্কুলে। স্কুলের পাঠ শেষ করে এমবিবিএস পড়তে পার্শ্ববর্তী ওড়িশায় চলে যান। ভর্তি হন কটক মেডিক্যাল কলেজে। কিছু দিন চিকিৎসাও করেন। তখন ধনেশ্বরপুরে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতেন। সেই সময় চিকিৎসক হিসেবে এলাকায় বেশ জনপ্রিয় হয়েছিলেন। মানুষের সঙ্গে সহজে মিশে যেতেন। ভাল বক্তব্য রাখতেন। সহজ ভাষায় কথা বলতেন। তাই সক্রিয় রাজনীতিতে আসার কিছু দিন পরই নেতৃত্বের নজরে পড়েন। এক সময় দলের স্থানীয় ব্লক কমিটির কনভেনরও ছিলেন।
১৯৭৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনে নারায়ণগড় থেকে প্রথম প্রার্থী হন। সেই বার অবশ্য কংগ্রেসের কৃষ্ণপ্রসাদ রায়ের কাছে পরাজিত হন। তবে হাল ছাড়েননি। ১৯৭৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে নারায়ণগড়ের দু’টি জেলা পরিষদ আসনের একটিতে তাঁকে প্রার্থী করে দল। জয়ীও হন। প্রথম বার জেলা পরিষদের আসনে জিতেই অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার সভাধিপতি হন। এরপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ঘাত-প্রতিঘাত যে আসেনি তা নয়। তবে নিজের দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতায় সেই সবকে তিনি সহজেই অতিক্রম করেছেন।
১৯৭৯ সালের ৭ জানুয়ারি থেকে ১৯৯১ সালের ১৮ এপ্রিল প্রায় তেরো বছর তিনি এই পদে ছিলেন। তাঁর আমলেই মেদিনীপুরে সাক্ষরতা অভিযান শুরু হয়। ১৯৯১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ফের নারায়ণগড়ে প্রার্থী হন। কংগ্রেসের সলিলদাস পট্টনায়েককে হারিয়ে বিধায়ক হন। প্রথম বার বিধানসভা নির্বাচনে জিতে রাজ্যের মন্ত্রিত্বও পান। এক সময় দীপক সরকারের সঙ্গে সূর্যকান্ত মিশ্রের সম্পর্ক ভালই ছিল। পরে অবশ্য সম্পর্কের অবনতি হয়। দলের অন্দরে সূর্যবাবুর সঙ্গে দীপকবাবুর বিরোধ বাধে। ১৯৯১ সালে কাঁথি সম্মেলনে সুকুমার সেনগুপ্তই দলের জেলা সম্পাদক হন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে পরের বছর তিনি অব্যাহতি নেন। দলের জেলা সম্পাদকের দায়িত্ব নেন দীপক সরকার। দীপকবাবু মনে করেছিলেন, নারায়ণগড়ের বিধায়ককে মন্ত্রী করে রাজ্যে পাঠিয়ে দেওয়া গেলে জেলায় তিনিই শেষ কথা বলবেন। সিপিএমের এক নেতা বলেন, “মন্ত্রী হয়ে সূর্যবাবু রাজ্য রাজনীতিতে পা রাখার পর জেলা রাজনীতিতে হয়েছেও ঠিক তাই!”
এই সময়ের মধ্যে কংসাবতী দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গিয়েছে। রাজ্যে পালাবদল হয়েছে। একের পর এক নির্বাচনে সিপিএমের বিপর্যয় হয়েছে। বদলে গিয়েছে সিপিএমের অন্দরের ছবিটাও। গত বিধানসভা নির্বাচনের আগে জেলায় দলের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বিশেষ দেখা যেত না সূর্যবাবুকে। বিধানসভা নির্বাচনের পরও ছবিটা বিশেষ বদলায়নি। লোকসভা নির্বাচনের পর সেই সূর্যবাবুকেই মেদিনীপুরে দলের এক সভায় প্রধান বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ জানান দীপকবাবু। বিপর্যয়ের ধাক্কাই কী দুই নেতার বিভাজন দূর করার সেতু তৈরি করেছে? না কি ভবিষ্যৎ পড়তে অসুবিধে হয়নি কারও? তাই দলের স্বার্থে দূরত্ব ঘুচিয়ে কাছাকাছি আসা? জল্পনা রয়েছেই।
শুরু থেকেই বিচক্ষণ নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন সূর্যবাবু। বিতর্ককে পাশ কাটিয়ে চলতেন। তাঁর প্রশাসনিক এবং সাংগঠনিক দক্ষতার কথা শোনা যায় বিরোধী দলের নেতাদের মুখেও। এমনকী দলের অন্দরে যাঁরা তাঁর কট্টর সমালোচক বলে পরিচিত, তাঁরাও দক্ষতার প্রশ্নে সূর্যবাবুর প্রশংসা করেন। নারায়ণগড়ের বাসিন্দা অনিল পাত্র, ভাস্কর দত্ত, তাপস সিংহ প্রমুখ সিপিএম নেতা বিশ্বাস করেন, বামপন্থী আন্দোলনকে যুগের প্রয়োজনে পরিচালনা করতে পারবেন সূর্যবাবু। সূর্যবাবু নিজেও মনে করেন, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলাই প্রয়োজন। একদিকে যেমন জ্যোতি বসু, প্রমোদ দাশগুপ্ত, সুকুমার সেনগুপ্তদের শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে এই কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে। অন্যদিকে তেমন দলে উত্তরসূরীদেরও তৈরি করতে হবে। যে সঙ্কট তৈরি হয়েছে তা মোকাবিলা করতে পারে একমাত্র বামপন্থীরাই।
সূর্যবাবু দলের রাজ্য সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর কী বলছেন দীপক সরকার। দীপকবাবু বলেন, “সূর্যকান্ত মিশ্র দলের রাজ্য সম্পাদক হয়েছেন। আমরা সবাই উৎসাহিত। উনি অপেক্ষাকৃত তরুণ। রাজ্যের দায়িত্ব পেলেন। প্রবীণ-নবীনের সমন্বয়েই দল এগোবে। আমরা বিশ্বাস করি, এই পরিস্থিতি বেশি দিন থাকবে না। মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেই আমরা এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারব।”
প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে রাজ্যে বিরোধী দলনেতার দায়িত্ব পালন করছেন নারায়ণগড়ের বিধায়ক। রাজ্য সিপিএমের এক নেতার কথায়, “আজকের দিনে সূর্যদার মতো নেতাকেই দলের প্রধান মুখ হিসেবে তুলে আনা দরকার ছিল। উনি কম কথা বলেন। কাজ বেশি করেন। সবার সঙ্গে মেলামেশা করেন। জীবনযাপনও সরল সাধাসিধে।” তাঁর মন্তব্য, “এই সময়ের মধ্যে দলের অনেক নেতাই ফাউল করেছেন! প্রকাশ্যে এমন মন্তব্য করেছেন যা নিয়ে জোর বিতর্ক হয়েছে। সূর্যদা অবশ্য একটাও ফাউল করেননি!”
মেদিনীপুরের এই চিকিৎসক নেতা আগেই অনেকগুলো মাইলস্টোন পেরিয়েছেন। শুক্রবার পেরোলেন আরও একটা মাইলস্টোন। তাঁর হাত ধরেই কী রাজ্যে সিপিএমের সূর্যোদয় শুরু হবে? বন্ধ হবে রক্তক্ষরণ? প্রশ্নের উত্তর দেবে ভবিষ্যৎই।