ছবি: সংগৃহীত।
গাঙ্গেয় শুশুক তথা ডলফিন জাতীয় জলজ প্রাণীর মর্যাদা পেয়েছে ২০১০ সালে। কিন্তু তাতে প্রাণীগুলোর যাকে বলে কপাল খুলে যাওয়া তা কিন্তু হয়নি। জাতীয় হওয়ার পরবর্তী ১০ বছরে এদের অস্বাভাবিক মৃত্যুর সংখ্যা নিয়মিত। এবারের স্বাধীনতা দিবসে প্রধানমন্ত্রী ডলফিন সংরক্ষণের কথা ঘোষণা করেছেন। তাতে আশা জাগছে।
কেন্দ্র গাঙ্গেয় শুশুক ও সামুদ্রিক ডলফিন, উভয় প্রাণীকেই সংরক্ষণ করবে। ‘প্রোজেক্ট ডলফিন’ একটি বহুমুখী প্রকল্প। এতে শুধু সংরক্ষণ নয় নদীর বাস্তুতন্ত্রের উপরেও জোর দেওয়া হচ্ছে। কর্মসংস্থান ও পর্যটন ক্ষেত্র তৈরির সম্ভাবনাও বাড়ার আশা। সংরক্ষণের এই উদ্দেশ্যের সঙ্গে অবিভক্ত মেদিনীপুরের কিছু জায়গা মেলে। এখানে গাঙ্গেয় ও সামুদ্রিক, দুই ডলফিনেরই দেখা মেলে।
পূর্ব মেদিনীপুরে কুকড়াহাটি এলাকায় হুগলি নদীর অংশে ডলফিন বেশি দেখা যায়। কুকড়াহাটি থেকে রায়চক, ডায়মন্ড হারবার ফেরি চলাচল করার শিপিং চ্যানেলে ডলফিন চলে আসে। একাধিকবার মৃত ডলফিন উদ্ধার করা হয়েছে কুকড়াহাটি থেকে। গেঁওখালি, দনিপুর এলাকায় ডলফিন দেখা যায়। পশ্চিম মেদিনীপুরে দাসপুর-২ ব্লকের কুলটিকরি, গোপীগঞ্জ, কৈজুড়ি, রানিচক হয়ে ঘাটালের হরিশপুর এসে থেমেছে রূপনারায়ণ। স্থানীয় মৎস্যজীবীদের অনেকেই রূপনারায়ণের উপর ভরসা করেই দিন গুজরান করেন। স্থানীয় কৈজুড়ি, গোপীগঞ্জ, রানিচক এলাকার কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, জোয়ারের জলে অনেক সময় ডলফিন ভেসে চলে আসে ওই এলাকায়। এপারে দাসপুরের কৈজুড়ির এবং অন্যপারে হুগলির পানশিউলি এলাকায় রূপনারায়ণ ও মুণ্ডেশ্বরীর সংযোগস্থলে শুশুক দেখা যায়। হলদি নদীর তীরে ডলফিন দেখতে অনেকেই ভিড় জমান। কৈজুড়ি এলাকাতেও ভিড় থাকে। স্থানীয় মাঝি অলোক সাঁতরা বললেন, “কয়েক মাস আগে কৈজুড়ি-কুলটিকরির মাঝে একটা ডলফিন স্লুইস গেট দিয়ে ঢুকে খালে ঢুকে পড়ে মারা গিয়েছিল। তার পরেও প্রশাসনের কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই।”
বাসিন্দাদের ক্ষোভ, ঘাটালের এত বড় এলাকা জুড়ে দীর্ঘদিন ধরেই ডলফিনের যাতায়াত। কিন্তু মৎস্য দফতর বা বন দফতরের কাছে ডলফিন নিয়ে কোনও তথ্যও নেই। জেলা মৎস্য আধিকারিক পিয়াল সর্দার অবশ্য বলেন, “ডলফিন নিয়ে খোঁজ খবর নেওয়া হয়। তবে নদীতে সমীক্ষা শুরু করা যায়নি। বিষয়টি নিয়ে ভাবনাচিন্তা চলছে।” বন দফতরের একপদস্থ আধিকারিক জানালেন, “ডলফিন মৎস্য দফতর দেখে। বন দফতরের কিছু করার নেই। স্থানীয়েরা খবর দিলে আমাদের কর্মীরা যায়।”
খড়গপুর আইআইটি-র স্কুল অব এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক জয়ন্ত ভট্টাচার্য জানালেন, জলে ডলফিনের সংখ্যা বাড়লে বোঝা যায় মাছের সংখ্যা বেড়েছে। ডলফিন সংরক্ষণ করতে গেলে সবচেয়ে আগে নদীর দূষণ কমাতে হবে। ড্রেজিং করার বিষয়টিও গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। ড্রেজিং করলে জলের গভীরতা বাড়বে। দূষণ কমবে। যে সময়ে নদীতে ডলফিন সক্রিয়তা বেশি থাকে সেই সময়টি চিহ্নিত করে জলপথ পরিবহণের গতিপথ ঠিক করতে হবে। আইসিএআর-সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অব ফিশারিজ এডুকেশনের প্রিন্সিপাল সায়েন্টিস্ট বি কে মহাপাত্র বলছেন, ‘‘ডলফিন দূষণের মাত্রা বুঝিয়ে দেয়। যে নদীতে দূষণ বেশি সেখানে এদের দেখা যায় না। এদের সংরক্ষণ জরুরি।’’
মহিষাদল রাজ কলেজে প্রাণিবিদ্যার বিভাগীয় প্রধান তথা ডলফিন গবেষক শুভময় দাস অবশ্য কয়েকটি আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘প্রচুর টাকা ঢালা হবে। প্রচুর গবেষক নিয়োগ করা হবে। প্রচুর সংস্থা গজিয়ে উঠবে। প্রচুর পর্যটন ক্ষেত্র হবে। কিন্তু নিশ্চিত ভাবে ডলফিনের সংখ্যা কমতে থাকবে। ফরেস্ট রিজার্ভ আছে। কিন্তু ওয়াটার রিজার্ভ এরিয়া এখনও ঘোষণা করা হল না। অন্তত পশ্চিমবঙ্গে দেখতে পাইনিl বারাণসী থেকে হলদিয়া পর্যন্ত জাহাজ এবং ট্রলার দাপিয়ে বেড়াবে জলে। একটা কোম্পানিকেও বলা যায়নি জল শোধন করে নদীতে ফেলুন! ন্যাশনাল ওয়াটার ওয়েজ চালু হলে বাস্তুতন্ত্র ভেঙে তছনছ হয়ে যাবে।’’ তাঁর দাবি, বালি তোলা, বেআইনি মাছ ধরা বন্ধ করতে হবে। তবেই বাঁচবে, বাড়বে জাতীয় জলজ প্রাণী।
(তথ্য সহায়তা: অভিজিৎ চক্রবর্তী, আরিফ ইকবাল খান)