—প্রতীকী চিত্র।
সালটা ২০১৬। পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুকের একটি পানের বরজ থেকে উদ্ধার হয় মুণ্ডহীন নারীদেহ। তার উপর ছিল ফুল, সিঁদুর ইত্যাদি। কিছুটা দূরে একটি পানাভর্তি খাল থেকে উদ্ধার হয় কাটা মাথা। ওই খুনের মামলায় বুধবার মূল অভিযুক্ত ‘তন্ত্রসাধক’ এবং মৃতার পরিবারের দুই সদস্যাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের নির্দেশ দিল আদালত। পাশাপাশি, ২০ হাজার টাকা জরিমানাও করা হয়েছে। আদালতে প্রমাণ হয়েছে, ব্যক্তিগত কারণে বিবাহবিচ্ছিন্না দিদিকে খুনের পরিকল্পনা করেন বোন। তাঁর সঙ্গ দেন বৌদি। দু’জনে মিলে পারিবারিক সূত্রে পরিচিত এক ওঝা তথা ‘তন্ত্রসাধক’ রামপদ মান্নাকে এই খুনের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। রামপদকে ৫ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। ‘কাজ’ শেষ হলে তাঁকে একটি ফ্ল্যাট উপহার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন দু’জন।
পেশায় ক্ষৌরকার রামপদের বাড়ি পূর্ব মেদিনীপুরে। তবে নিউটাউন এলাকায় সেলুন ছিল তাঁর। কর্মসূত্রে সেখানে থাকতেন। পাশাপাশি, ঝাড়ফুঁকও ছিল তাঁর আর একটি পেশা। রামপদের সেলুনের পাশেই ছিল বাণী সর্দার নামে এক মহিলার চা-তেলেভাজার দোকান। সেই সূত্রে দু’জনের মধ্যে ভাল সম্পর্ক তৈরি হয়। পরস্পরের বাড়িতে যাতায়াতও ছিল তাঁদের। বাণীর ছেলেমেয়েরাও রামপদকে ভালবাসতেন। পুলিশ সূত্রে খবর, ২০১৬ সালে বাণীর বড় মেয়ে পার্বতীর বিবাহবিচ্ছেদ হয়। তিনি বাপের বাড়িতে থাকতে শুরু করেন। কিন্তু দিদি বাড়িতে থেকে গেলে সম্পত্তির ভাগ দিতে হবে— এই আশঙ্কায় ষড়যন্ত্র শুরু করেন বোন পুঁটি। তিনি এ নিয়ে আলোচনা শুরু করেন বৌদি টুকটুকির সঙ্গে। এর পর পার্বতীকে খুনের চক্রান্ত হয় রামপদকে নিয়ে।
পারিবারিক এবং মানসিক শান্তির জন্য পার্বতীকে বিশেষ পুজো করার পরামর্শ দেন ‘তন্ত্রসাধক’ রামপদ। তাঁর কথায় রাজি হয়ে ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর নিউটাউন থেকে তমলুকের উদ্দেশে রওনা হন পার্বতী। রামপদ সঙ্গেই ছিলেন। এর পরই পার্বতীর ক্ষতবিক্ষত দেহ উদ্ধার হয়। হত্যার আগে তাঁকে যৌন হেনস্থারও অভিযোগ ওঠে। সাত বছরের পুরনো ওই মামলায় অবশেষে রামপদ, পুঁটি এবং টুকটুকিকে দোষী সাব্যস্ত করেছে আদালত।
পুলিশ সূত্রে খবর, ঘটনার দিন সন্ধ্যায় মেচেদা স্টেশনে নামার পর একটি দশকর্মা ভান্ডার থেকে সিঁদুর, আলতা, ধূপ-ধুনো ইত্যাদি কেনেন রামপদ। হার্ডওয়্যারের দোকান থেকে কেনা হয় ধারালো ছুরি। এর পর তমলুকের গড়কিল্লায় একটি পানের বরজে পার্বতীকে নিয়ে যান রামপদ। সেখানে তাঁকে নগ্ন করে তন্ত্রসাধনা চলে। জ্বলন্ত ধুনো পার্বতীর নগ্ন শরীরে ছেটানো হয়। তার পর ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাঁর ধড় ও মুণ্ড আলাদা করে দেন রামপদ। ব্যাগের মধ্যে মুণ্ড ভরে ৪১ নম্বর জাতীয় সড়ক বরাবর হেঁটে উত্তর ওষুধপুর গ্রামে একটি কচুরিপানা ভর্তি পুকুরে সেটি ফেলে দিয়ে চম্পট দেন রামপদ।
পানের বরজে রক্তাক্ত দেহ দেখে পুলিশে অভিযোগ করেন রামপদের বাবা। কারণ, ওই বরজটি তাঁরই। কিন্তু পুলিশ তদন্তে নেমে তাঁর ছেলেকেই গ্রেফতার করে। গ্রেফতার হন ওই দুই মহিলাও। বুধবার তিন জনকে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২ (খুন) এবং ১২০ বি (অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র) এবং ২০১ (প্রমাণ লোপাট) ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে সাজা ঘোষণা করে তমলুক আদালত। এই প্রসঙ্গে সরকারি আইনজীবি সৌমেনকুমার দত্ত বলেন, “পুলিশ মোবাইল ফোনের টাওয়ার লোকেশন ট্র্যাক করে রামপদের জড়িত থাকার বিষয়ে নিশ্চিত হয়। তা ছাড়া, মুণ্ড নিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় দু’জন স্থানীয় বাসিন্দা তাঁকে দেখে ফেলেছিলেন। তাঁরাও মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন। পুলিশ দ্রুত তদন্ত শেষ করেছিল। কিন্তু করোনার জন্য শুনানি পিছিয়ে গিয়েছিল। তাই সাজা ঘোষণায় দেরি হল।’’