ছাদ থেকে চুঁইয়ে পড়ছে জল।
বৃষ্টির জলে ভাসছে চিঠি!
খড়্গপুর বোগদার উপ-ডাকঘরে চিঠিপত্র বাছাইয়ের কাজ করছিলেন কর্মী দুলাল দত্ত। হঠাৎ মুষলধারে বৃষ্টি। সঙ্গে সঙ্গে ছাদ চুঁইয়ে জল পড়া শুরু। টেবিলের উপরও টপটপ করে পড়ছে জল। তড়িঘড়ি দুলালবাবু চিঠিপত্র সরাতে শুরু করলেন। যদিও তাতে বিশেষ লাভ হল না। ততক্ষণে জলে ভেসে যাচ্ছে গোটা ঘর। বাধ্য হয়ে পোস্টম্যান তারিনীকান্ত পণ্ডিতকে ডাকলেন দুলালবাবু। একটি পলিথিনের ছেঁড়া ত্রিপল নিয়ে তারিনীবাবুও ছুটে এসে কোনও ক্রমে চিঠি বাঁচানোর চেষ্টা করলেন। এরপর প্রৌঢ় দুলালবাবু পোস্টম্যানের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘আমাদের তো অবসরের সময় হয়ে আসছে। যন্ত্রণাটা রয়েই গেল। এই যন্ত্রণা থেকে কবে মুক্তি পাব।”
ছাদের কথা না হয় গেল। ডাকঘরের জানলাও ভাঙা। জানলা বন্ধ করতে গেলে যে কেউ ভিজে যাবেন। বেশি নাড়াচাড়া করলে জানলার পাল্লা খুলে হাতে চলে আসাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। ভেঙে পড়ছে ছাদের চাঙড়। বিপজ্জনক ভাবে ঝুলছে বিদ্যুতের তার। তার মাঝেই বসে কাজ করছেন ডাকঘরের কর্মীরাও। এক কর্মীর কথায়, ‘‘বিপদ নিয়েই কাজ করতে হচ্ছে। যে কোনও সময় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।’’
অভিযোগ, ডাকঘরের সব কাউন্টারও প্রতিদিন খোলে না। ফলে দীর্ঘ লাইন পড়ে। ডাকঘরে প্রতিদিন দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে দুর্ভোগের শিকার হন গ্রাহকেরা। বসার উপযুক্ত জায়গা না থাকায় প্রবীণ মানুষ ও শিশুদের কষ্ট হয়। ডাকঘর কর্তৃপক্ষের দাবি, রেলের ভবনে ডাকঘরটি চলছে। ফলে কোনও নির্মাণকাজ করা যায় না। দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়ায় জীর্ণ হচ্ছে বাড়ি।
ডাকঘরের গ্রাহক অবসরপ্রাপ্ত রেলকর্মী গৌতমকান্তি সাহা বলেন, “দীর্ঘদিন এই ডাকঘরের একইরকম অবস্থা দেখছি। কোনও উন্নতি হয়নি। যে ভাবে ডাকঘরের ভবনের ছাদের চাঙর ভেঙে পড়ছে তাতে এখানে দু’মিনিট দাঁড়াতেও ভয় লাগে।’’ তাঁর আরও অভিযোগ, ‘‘ব্যাঙ্কে গেলে যে কাজ এখন পাঁচ মিনিটে হয়, সেই কাজ এখানে করতে এক ঘণ্টা সময় লাগে। ঐতিহ্যবাহী এই ডাকঘরের পরিষেবার মানোন্নয়ন প্রয়োজন।”
বোগদার এই উপ-ডাকঘরে প্রায় দেড় লক্ষ অ্যাকাউন্ট রয়েছে। এই ডাকঘর থেকেই ২৩টি ডাকঘরকে অর্থ দেওয়া হয়। এ ছাড়াও দফতরের ২০টি শাখা অফিসও এই ডাকঘরের অধীনে। ডাকঘর সূত্রে জানা গিয়েছে, ঘরের ভাড়া বাবদ রেলকে প্রতি মাসে ৭৩ হাজার টাকা দিতে হয়। নিয়ম অনুযায়ী, ওই ভবনের সংস্কার করার কথা রেল কর্তৃপক্ষের। কিন্তু রেল এ বিষয়ে নজর দেয় না বলে অভিযোগ।
ডাকঘরের পোস্টমাস্টার অরুণ নন্দী বলেন, “আমি নতুন এসেছি। ছাত্র থাকার সময়েও এই ডাকঘরের একইরকম অবস্থা দেখেছি। একাধিক বার রেলকে এ বিষয়ে জানিয়েছি।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘এ বিষয়ে আমাদের ঊর্ধ্বতন আধিকারিকেরা ভাল বলতে পারবেন। ভবনের সংস্কার হলে গ্রাহকদের পাশাপাশি আমরাও উপকৃত হব।” কর্মী সঙ্কটে ডাকঘরের পরিষেবার মানও তলানিতে। ডাকঘরে ১৮ জন কর্মী থাকার কথা। এখানে সেখানে রয়েছেন ১১ জন কর্মী। ছ’টি কাউন্টারের বদলে এখন খোলা থাকে মাত্র ৩টি কাউন্টার। যদিও অধিকাংশ দিনই মাত্র একটি কাউন্টার খোলা থাকে বলে অভিযোগ। ডাকঘরের গ্রাহক স্বদেশরঞ্জন কর, মধুসূদন মণ্ডল বলেন, “কর্মীর অভাবে অধিকাংশ সময় কাউন্টার বন্ধ থাকে। সবসময় ডাকঘরে ভিড় থাকে।’’ তাঁদের অভিযোগ, ‘‘লাইনে অপেক্ষা করলেও তো ভয় রয়েছে। ছাদের চাঙড় ভেঙে পড়লে বিপদ ঘটে যেতে পারে। কর্তৃপক্ষের পরিষেবার দিকটি মাথায় রাখা উচিত।”
এ বিষয়ে ডাকঘরের মেদিনীপুর ডিভিশনের সিনিয়ার সুপারিন্টেনডেন্ট আন্সুয়া প্রসাদ বলেন, “ওই ডাকঘরের ভবন রেলের। একাধিক বার রেলকে ভবন সংস্কারের কথা বলেও সুফল পাচ্ছি না। ভাড়ার বকেয়া ৮০ লক্ষ টাকা রেলকে দিলেও পরিকাঠামো মানোন্নয়নের কাজ হয়নি। অন্যত্র অফিস স্থানান্তরের চেষ্টা করছি।” তাঁর কথায়, ‘‘কর্মীর অভাবে একটু সমস্যা রয়েছে ঠিকই। তবে কোথাও পরিষেবা যাতে ব্যাহত না হয় সে জন্য আমরা চেষ্টা করছি।”
ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।