—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
পয়েন্ট সেট ছিল লুপ লাইনে। অথচ মেন লাইনে সিগন্যাল লালের বদলে হয়েছিল সবুজ। তা দেখেই দ্রুত গতিতে এগিয়ে ওড়িশার বাহানাগা বাজার স্টেশনের কাছে ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনায় পড়েছিল করমণ্ডল এক্সপ্রেস। গত বছর জুনের কথা।
বছর ঘুরে সেই জুন। এ বার উত্তরবঙ্গের রাঙাপানি স্টেশনের কাছে দুর্ঘটনায় পড়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস। এ ক্ষেত্রেও সিগন্যাল বিকল থাকায় পেপার ক্লিয়ারেন্স নিয়ে এগিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে ধাক্কা মেরেছে মালগাড়ি। ফলে, প্রশ্ন, এক বছরেও কি সিগন্যালের ‘ভূত’ ছাড়াতে
পারেনি রেল!
ওড়িশার বাহানাগা বাজার স্টেশনের কাছে গত বছর ২ জুন করমণ্ডল এক্সপ্রেস যে দুর্ঘটনায় পড়ে, তাতে প্রাণ হারান ২৯৩ জন। তদন্তে জানা যায়, গেট বুম ও রিলে রুমে কাজ চলায় সিগন্যাল ব্যবস্থায় গোলমাল সত্ত্বেও ওই লাইনে সতর্কতা ছাড়াই চালানো হচ্ছিল ট্রেন। পয়েন্ট লুপ লাইনে সেট থাকলেও মেন লাইনের সিগন্যাল লালের বদলে হয়েছিল সবুজ। বিপত্তি তাতেই।
‘কমিশনার অব রেলওয়ে সেফটি’ ও সিবিআই তদন্তে উঠে এসেছিল মানুষের ভুলের কথা। রিলে রুমে কারসাজি করে পয়েন্ট রিভার্সে থাকা সত্ত্বেও মেন লাইনের সিগন্যাল লাল হয়নি বলে দাবি করা হয়েছিল। ঘটনায় সিনিয়র সেকশন ইঞ্জিনিয়ার (সিগন্যাল) অরুণকুমার মহান্ত, সেকশন ইঞ্জিনিয়ার আমির খান-সহ ৩ জনকে গ্রেফতার করে চার্জশিটও দিয়েছে সিবিআই। তবে রেল যে সুরক্ষিত হয়নি কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনাই তার প্রমাণ। কারণ এখানেও রাঙাপানি স্টেশন থেকে চটেরহাট পর্যন্ত অকেজো ছিল সিগন্যাল ব্যবস্থা। ট্রেন চালানো হচ্ছিল পেপার ক্লিয়ারেন্স বা কাগজে দেওয়া অনুমতি নিয়ে।
সে ক্ষেত্রে নিয়ম, প্রতিটি লাল সিগন্যাল অতিক্রমের আগে এক মিনিট দাঁড়াতে হবে ট্রেনকে। আর গতি থাকবে ১৫ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা। কাগুজে ছাড়পত্র থাকা সত্ত্বেও কেন দ্রুত গতিতে আসছিল মালগাড়ি, সেটাই প্রশ্ন।বাহানাগা বাজার স্টেশন যে রেল ডিভিশনে, সেই খড়্গপুর রেলের সিনিয়র ডিভিশনাল কমার্শিয়াল ম্যানেজার অলোক কৃষ্ণ বলছেন, ‘‘বাহানাগা বাজারে করমণ্ডল দুর্ঘটনায় পয়েন্ট-সিগন্যালের ত্রুটি কারণ ছিল। কিন্তু কাঞ্চনজঙ্ঘার ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ঘটেছে মানুষের ভুলে।’’
রেলের এক সূত্রের দাবি, পেপার ক্লিয়ারেন্সে চটেরহাট স্টেশনের দিকে যাওয়া মালগাড়ির লোকো পাইলট নিয়ম মানেননি। প্রশ্ন আছে মালগাড়ির গতিবেগ নিয়েও। তবে রেলকর্মীদের একটা অংশ বলছেন, পূর্ণাঙ্গ তদন্তের আগে লোকো পাইলটের উপর সম্পূর্ণ দায় চাপানো উচিত নয়। খড়্গপুর ডিভিশনের এক লোকো পাইলটের কথায়, ‘‘হয়তো সাময়িক ভাবে বিকল সিগন্যালে সবুজ আলো দেখেই গতি বাড়িয়ে এগিয়েছিল মালগাড়ি। আর তার আগে হোম সিগন্যাল লাল দেখে নিয়ম মেনে এক মিনিট দাঁড়িয়েছিল কাঞ্চনজঙ্ঘা। মৃত লোকো পাইলটের বিরুদ্ধে আঙুল তোলা সহজ। কিন্তু মূল সমস্যা তো সিগন্যালেই!’’
একই মত বাহানাগাবাসীরও। কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসে দুর্ঘটনার কথা শুনেছেন বাহানাগা বাজারের বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত বিএসএনএল কর্মী নীলাম্বর বেহেরা। তিনি বলেন, ‘‘এ যেন অভিশপ্ত জুন। ফের সেই সিগন্যাল অকেজো থাকার গল্প। রেল কেন সিগন্যাল ব্যবস্থাকে উন্নত করতে পারছে না?’’ স্থানীয় ব্যবসায়ী মহেশ গুপ্তরও বক্তব্য, ‘‘রেল তো দেখছি এক বছরেও এই সিগন্যালের ভূত তাড়াতে পারেনি।’’ বাহানাগা পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি, বিজেপি নেতা বিশ্বনাথ মিশ্রও বলেন, ‘‘আমরা আর দুর্ঘটনা চাই না। রেলের উচিত সিগন্যাল-সহ যাবতীয় সুরক্ষা ব্যবস্থায় সতর্ক হওয়া।’’
খড়্গপুর রেলের সিনিয়র ডিভিশনাল কমার্শিয়াল ম্যানেজার অলোক কৃষ্ণর অবশ্য দাবি, ‘‘বাহানাগা বাজারে দুর্ঘটনার পরে আমরা আমাদের ডিভিশনে সিগন্যাল নিয়ে অনেক সতর্ক হয়েছি। কোথাও কাজ হলে সিগন্যাল বিভাগ ছাড়পত্র দিলেও আমরা দ্বিতীয়বার পরীক্ষা করে তবেই এখন ট্রেন চালাই।’’