ভোটের আর এক মাসও বাকি নেই। এখন দেওয়াল ফাঁকাই। মেদিনীপুর শহরের অরবিন্দনগরে। — নিজস্ব চিত্র।
এই সে দিনও ভোটের মুখে পাড়ার দেওয়ালগুলো বিলকুল পাল্টে যেত। নোনাধরা, স্যাঁতস্যাঁতে দেওয়ালও সেজে উঠত প্রার্থীর নাম, প্রতীক আর বাহারি ছড়ায়। এ বার ছবিটা অনেকটাই আলাদা। অনেক দেওয়ালই সাদা চুন লাগানো অবস্থায় পড়ে রয়েছে। এখনও প্রার্থীদের নাম-চিহ্ন লেখা-আঁকা হয়নি। কারণ, দেওয়াল লেখার শিল্পীর অভাব। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক দলের নেতারা মানছেন, ছড়া বা ব্যঙ্গচিত্রে দেওয়াল সাজাতে যতটা সময় আর যে ধরনের ভাবনাচিন্তা লাগে, এখন তারও আকাল।
অথচ নির্বাচনী প্রচারে বরাবরই দেওয়াল লিখন গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। একটা সময় ছিল যখন ছড়ায়-ছবিতে দেওয়াল লিখন রীতিমতো শিল্পের পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। এখন সেই শিল্পেই ভাটার টান। উল্টে অনেক বেশি নজর কাড়ছে ফেসবুক ওয়ালে নানা টিপ্পনী, ব্যঙ্গচিত্র। তবে রাজনৈতিক দলের নেতাদের বক্তব্য, সংখ্যায় কমলেও দেওয়াল লিখনের দিন একেবারে ফুরিয়ে যায়নি। তৃণমূলের জেলা সভাপতি দীনেন রায় বলেন, ‘‘দেওয়াল লেখা চলছে। তবে এটা ঠিক বছর কয়েক আগেও যে সংখ্যক দেওয়াল লেখা হত, এখন তা হয় না। লেখার কর্মীর সংখ্যাও কমে গিয়েছে।’’ সিপিআইয়ের জেলা সম্পাদক সন্তোষ রাণার কথায়, ‘‘এখন অনেক খোঁজ করলে লেখার কর্মীর মেলে। দেওয়াল লেখার ক্ষেত্রে অনেক বিধিনিষেধ এসেছে। আগে এত ছিল না।” বিজেপির জেলা সভাপতি ধীমান কোলেও মানছেন, চাইলেই এখন আর দেওয়াল লেখার কর্মী মেলে না। আর কংগ্রেসের জেলা সভাপতি বিকাশ ভুঁইয়া বলেন, “দেওয়াল লেখার দিন পুরোপুরি কখনও যাবে না। তবে কর্মীর অভাবে আগের থেকে দেওয়াল লেখার সংখ্যা কমেছে।’’
জেলার প্রায় সর্বত্রই দেওয়াল লেখায় এখন ভাটার টান। নিছক গদ্য নয়, বরং ছড়া-ছবি-কার্টুন থাকলে দেওয়াল নজর কাড়ে। কিন্তু, মেদিনীপুরের মতো শহরেও এমন নজরকাড়া দেওয়াল চোখে পড়ছে খুবই কম। রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্ব অবশ্য বলছেন, দিন কয়েকের মধ্যে আরও অনেক দেওয়াল ছড়া-ছবিতে ভরে উঠবে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য কিছু এগিয়ে তৃণমূল। নির্বাচনী নির্ঘন্ট ঘোষণার দিনই তৃণমূলের প্রার্থী তালিকা ঘোষণা হয়েছিল। ফলে, কর্মীরা সময় নষ্ট না করে দেওয়াল লেখার কাজে নেমে পড়েন। ইচ্ছে থাকলেও এই কাজ শুরু করতে পারছিলেন না সিপিএম, কংগ্রেস, বিজেপির মতো বিরোধী দলের কর্মীরা। তৃণমূলের পর প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করে বামেরা। তারপর বিজেপি। দিন কয়েক আগে প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করেছে কংগ্রেস। খড়্গপুরের এক কংগ্রেস নেতা মানছেন, “প্রার্থী তালিকা দেরিতে প্রকাশ হয়েছে। তাই দেওয়াল লেখায় আমরা কিছুটা পিছিয়ে পড়েছি। তবে মনে হচ্ছে, সামনের সপ্তাহের মধ্যে অনেক দেওয়ালই লেখা হয়ে যাবে। চুন তো লাগানোই রয়েছে!” তৃণমূলের এক নেতার আক্ষেপ, “এখন দেওয়াল লেখার ক্ষেত্রে এত বিধিনিষেধ যে সব দলই উৎসাহ হারাচ্ছে।’’ সিপিএমের এক নেতা আবার বলেন, “এটা ঠিক, চোখের সামনে দেওয়াল লিখন দেখলে মানুষ লেখাগুলো পড়েন। তবে এখন কর্মীদের অনেকে
ফেসবুকে স্বচ্ছন্দ।”
দেওয়াল লেখার বিকল্প হিসেবে এখন উঠে এসেছে ফ্লেক্স। ফ্লেক্স সহজেই এ দিক-সে দিক রাখা যায়। সহজে মানুষের নজর কাড়ে। খরচও কম। কেমন? প্রতি বর্গফুট ফ্লেক্স ছাপানোর জন্য খরচ পড়ে ৮-১০ টাকা। ফলে, প্রার্থীদের অনেকেই এখন দেওয়াল লেখার ঝোঁক ছেড়ে ফ্লেক্সের দিকে ঝুঁকছেন। তৃণমূলের এক প্রার্থী যেখানে দু’হাজার ফ্লেক্সের বরাত দিয়েছেন, সেখানে দেওয়াল লেখার বরাত দিয়েছেন মাত্র তিনশোটি। ওই প্রার্থীর কথায়, “ভোটের সময় দেওয়াল লিখতে হয় তাই লেখা! একজন একদিনে তিন-চারটের বেশি দেওয়াল লিখে উঠতেও পারে না। ফ্লেক্সের ঝক্কি অনেক কম। আজ বরাত দিলে কালই পাওয়া যায়। চাইলে দিনে দিনেও পাওয়া যায়।”
অগত্যা, টিকে থাকতে দেওয়াল লেখার খরচও কমাতে বাধ্য হয়েছেন পেশাদার শিল্পীরা। শিল্পী সুমন্ত জানার কথায়, “এখন ফ্লেক্সের যুগ। লোকে দেওয়াল লিখবে কেন! এখন দেওয়াল লেখার খরচও বর্গফুটে হচ্ছে। সাধারণ লেখার জন্য প্রতি বর্গফুটে ৮ টাকা নিই। ছড়া- ছবি থাকলে একটু বেশি। ভোট এলেই যা কাজ পাই।” সুমন্ত বলছেন, “আগে প্রচুর দেওয়াল লেখা হত। এখন সামান্য সংখ্যক দেওয়ালই লেখা হয়। অনেকে তো এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশাও খুঁজে নিয়েছেন।’’