খরিদা লেভেল ক্রসিংয়ে চলছে ঝুঁকির পারাপার। সতর্ক করার কোনও উদ্যোগ নেই।
সেটা ২০১৪ সাল। জানুয়ারির এক সকালে বন্ধ ছিল লেভেল ক্রসিং। ট্রেন আসতে দেরি হওয়ায় জমছিল ভিড়। ধৈর্য হারিয়ে অনেকেই সাইকেল-মোটবাইক নিয়ে বন্ধ ছিল লেভেল ক্রসিং পারাপার করছিলেন। সাইকেলে ছিলেন ব্যাঙ্কের নিরাপত্তাকর্মী রবীন চৌধুরী। কানে মোবাইল। বন্ধ লেভেল ক্রসিং পেরনোর সময় ঘাড়ের কাছে এসে পড়েছিল হাওড়াগামী পুরুলিয়া এক্সপ্রেস। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সব শেষ। ট্রেনটা চলে যেতে পাওয়া গিয়েছিল রবীনবাবুর দেহ।
খড়্গপুরের খরিদা লেভেল ক্রসিংয়ে সেই দৃশ্য এখনও অনেকে ভুলতে পারেনি। তবে বাড়েনি সচেতনতাও। একইভাবে রেললাইন পারাপার চলছে। এ ক্ষেত্রে সচেতনতা বাড়াতে রেলের পক্ষ থেকে পথনাটকের আয়োজন করা হয়। বার্তা দেওয়া হয়, বন্ধ লেভেল ক্রসিং পারাপার আইনত দণ্ডনীয়। অথচ মেদিনীপুর-হাওড়া ব্যস্ত রেলপথের মাঝে খড়্গপুরের খরিদা ও অরোরা রেলগেটে এমন সচেতনতা শিবির দেখা যায় না।
প্রতিবছর ঘটা করে ট্রেন দুর্ঘটনার মোকাবিলায় নানা কর্মসূচি পালন করা হয়। বৃহস্পতিবারও খড়্গপুরের নিমপুরায় দুর্ঘটনার মহড়ার আয়োজন করা হয়েছিল। দূরপাল্লার ট্রেনের দু’টি কামরা লাইনের উপরে উল্টে দেওয়া হয়। কামরায় ছিল বহু মানুষের মডেল। এরপরই দেখানো হয় রেল আধিকারিক, অ্যাম্বুল্যান্স-সহ চিকিৎসক দল, জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী সকলের উপস্থিতিতে কী ভাবে উদ্ধারকাজ চলে। দুর্ঘটনা মোকাবিলায় কোথাও কোনও ফাঁকফোঁকর রয়েছে কিনা, তাও খতিয়ে দেখা হয়। তবে মালঞ্চর বাসিন্দা সুবীর সেনের আক্ষেপ, “রেলের এমন কর্মসূচির গুরুত্ব রয়েছে। তবে আসল সময় এ গুলির সঠিক প্রয়োগ দেখা যায় না।’’ রেললাইন পেরোতে গিয়ে মৃত্যু ঠেকাতে কী করণীয়, রেলের সেটাও ভাবা উচিত।
বন্ধ লেভেল ক্রসিং পারাপার ঠেকাতে রেল কেন জোর দিচ্ছে না, সে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে রেলশহর জুড়েই। গত মার্চে নিমপুরা ঘেঁষা সাদাতপুরে একটি প্রহরী-বিহীন লেভেল ক্রসিং পেরোতে গিয়ে এক্সপ্রেস ট্রেনের সঙ্গে অটোর ধাক্কায় মৃত্যু হয়েছিল তিন অটোযাত্রীর। রেলের দাবি, বছরের বিভিন্ন সময়ে রেল সুরক্ষায় সচেতনতা শিবির করা হয়। স্টেশন চত্বরে ফুটব্রিজ ব্যবহার, পরিত্যক্ত ব্যাগে হাত না দেওয়ার মতো বার্তা দিতে পথনাটিকাও হয়। কিন্তু খরিদা ও অরোরায় বন্ধ লেভেল ক্রসিং পারাপার ঠেকাতে কখনও সচেতনতা শিবির ও পথনাটিকা দেখা যায় না। খরিদার ব্যবসায়ী নারায়ণ দাস বলেন, “বহু দুর্ঘটনা ঘটেছে খরিদা ও অরোরা রেলগেটে। তবু লাইন পারাপার থামেনি। রেলের তরফে কাউকে সচেতন করতে দেখিনি।’’
অবশ্য এ কথা মানতে নারাজ খড়্গপুরে রেলের সিনিয়র ডিভিশনাল সেফটি অফিসার শুকদেব মাহাতো। তিনি বলেন, “আমরা অনেক সচেতনতা শিবির করি।’’ কিন্তু দুর্ঘটনাপ্রবণ লেভেল ক্রসিং পারাপারে কি কোনও সচেতনতা কর্মসূচি হচ্ছে না? এ বার শুকদেববাবু ‘ব্যস্ত আছি’ বলে এড়িয়ে যান। তবে খড়্গপুরের এডিআরএম মহম্মদ আরসাদ আলমের আশ্বাস, ‘‘আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে আমরা খরিদা ও গিরিময়দান এলাকায় সচেতনতা শিবির করব।’’
আগে একটি রেললাইন থাকলেও এখন গোকুলপুর থেকে গিরিময়দান পর্যন্ত ডবল লাইন হয়ে যাওয়ায় ট্রেনের সংখ্যা বেড়েছে। তীব্র গরমে দিনের ব্যস্ত সময়ে দীর্ঘক্ষণ লেভেল ক্রসিং বন্ধ পড়ে থাকায় মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙছে। নিয়ম উড়িয়ে চলছে রেললাইন পারাপার। এই পরিস্থিতিতে খরিদা ও অরোরায় উড়ালপুলের দাবি জোরদার হচ্ছে। ছত্তীসপাড়ার এস নাগু যেমন বলেন, “কবে থেকে শুনছি এই দুই রেলগেটের উপর উড়ালপুল হবে। টাকাও বরাদ্দ হয়েছে বলে শুনেছি। কিন্তু কিছুই তো হচ্ছে না। ব্যস্ত সময়ে লাইন না পার করে উপায় কী!” রেল সূত্রে খবর, গত ২ ফেব্রুয়ারি খড়্গপুরে এসে ৫৮ কোটি টাকা ব্যয়ে উড়ালপুল গড়া হবে বলে জানিয়েছেন দক্ষিণ-পূর্ব রেলের জেনারেল ম্যানেজার একে গোয়েল। কাজ কবে শুরু হবে? খড়্গপুরের এডিআরএম আরসাদ আলম বলেন, ‘‘ওই উড়ালপুল গড়ার জন্য আমাদের পক্ষ থেকে সব পরিকল্পনা হয়ে গিয়েছে। রাজ্য সরকারের কাছে পরিকল্পনা গৃহীত হলেই উড়ালপুলের কাজে হাত
দেওয়া হবে।’’
—নিজস্ব চিত্র।