সন্দেশখালিতে অশান্তি। —ফাইল চিত্র।
সন্দেশখালিতে রাজনৈতিক মদতে দুষ্কৃতীদের বর্বরতা ও অত্যাচারের ঘটনা নিয়ে রাজ্য-রাজনীতি যখন তোলপাড় তখন ভিন জেলা পূর্ব মেদিনীপুরের ভগবানপুরের মানুষের বার বার মনে পড়ে যাচ্ছে তৃণমূল নেতা নান্টু প্রধানের দুষ্কৃতী বাহিনীর কথা।
টেলিভিশনে পর্দায় সন্দেশখালির কৃষক ও মহিলাদের উপর অত্যাচারের কাহিনীর সঙ্গে অসম্ভব মিল খুঁজে পাচ্ছেন তাঁরা এক দশক আগের নান্টু-বাহিনীর তাণ্ডবের। সেই নান্টুর খুন হওয়ার ভেড়ি দখলের রাজনীতি কফিনবন্দি হয়। তার পর থেকেে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেনএলাকার মানুষ।
সালটা ২০১৫। তখন তৃণমূলের রাজত্ব মধ্যগগনে। ভগবানপুরের তৃণমূলের বেতাজ বাদশা ছিল নান্টু প্রধান। মহম্মদপুর-২ গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান হলেও তার বিচরণ ছিল গোটা ভগবানপুর জুড়ে। নোনা জলে যে সোনা ফলে, সেটা খুব ভাল বুঝেছিল নান্টু। শুরু করেছিল দখলদারির রাজনীতি। তখন অধিকারীদের হাত নান্টুর মাথায় ছিল বলে অভিযোগ।
পরবর্তীতে অধিকারীদের ডিঙিয়ে মন্ত্রিসভার নেতাদের সঙ্গে ওঠাবসা শুরু হয় নান্টু প্রধানের। জবরদস্তি অনিচ্ছুক কৃষকদের চাষের জমিতে নোনোজল ঢুকিয়ে নিজে ভেড়ি তৈরি করে সে। জনাদাঁড়ি ও মহম্মদপুরে প্রায় একশো থেকে দেড়শো বিঘা এলাকায় ভেড়িতে চাষের ব্যবস্থা ছিল। রাজনৈতির ক্ষমতাবলে ও নেতাদের মদতপুষ্ট হয়ে বিরোধীদের তুলে নিয়ে গিয়ে মারধর ও মহিলাদের শ্লীলতাহানির মতো অসংখ্য ঘটনায় যুক্ত থাকার অভিযোগ উঠেছিল নান্টুর বাইক বাহিনীর বিরুদ্ধে।
ভেড়ির জন্য জমি দিতে অস্বীকার করলে বা সভা-মিছিলে যেতে রাজি না-হলে রাতে বাড়ি থেকে বাইকবাহিনী তুলে নিয়ে যেত দেড়দিঘিতে। চলতো বেধড়ক মার আর অত্যাচার। আধমারা করে দুষ্কৃতীরা বাড়িতে ফেলে দিয়ে যেতো। চাষের জমি দখল করায় দুবেলা ভাতের জোগাড়ে ধান চাষ করতে পারতেন না এলাকার মানুষ। নান্টু ও তার শাগরেদরা ভগবানপুরের গুড়গ্রাম, মহম্মদপুর-১ অঞ্চল সহ একাধিক মৌজায় ভেড়ি দখলদারি শুরু করে। প্রতিবাদ করলেই গ্রামবাসীদের অকথ্য নির্যাতনের মুখে পড়তে হত।
নান্টুর বাহিনী রাতে দরজা ভেঙে বাড়ির মহিলাদের তুলে নিয়ে যেত বলে অভিযোগ ছিল। পুলিশ ও প্রশাসন এই দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিতে বা পদক্ষেপ করতে সাহস পেত না বলে অভিযোগ। সন্দেশখালির ঘটনায় ভগবানপুরের মানুষ যেন হুবহু সেই অন্ধকার যুগের পুনরাবৃত্তি দেখছেন। ঠিক যেমন জনরোষ এখন সন্দেশখালিতে দেখা যাচ্ছে তেমন পুঞ্জীভূত ক্ষোভের আগুনে ২০১৮ সালে ফেব্রুয়ারিতে গ্রামবাসীদের হাতে জলামাঠেখুন হয় নান্টু।
নান্টুর দখলে থাকা ভেড়ি কৃষকেরা ফিরিয়ে নিয়ে নিজেদের মতো করে মাছ চাষ করছেন। কেউ ভেড়ি ভরাট করে চাষবাস করছেন। ভগবানপুরের ভেড়ি চাষের সেই কারবার এখন প্রায় নেই বললেই চলে। ভগবানপুরের মানুষ এখন নিজেদের মতো শান্তিপূর্ণ ভাবে এখন বসবাস করেন। এখন তাঁদের জমি কেউ কেড়ে নিতে আসে না। গত কয়েক দিনের সন্দেশখালির উত্তপ্ত পরিস্থিতি সে সময়ের অরাজকতা স্মৃতি তাঁদের মনেকরিয়ে দিচ্ছে।
দখল হয়ে যাওয়া জমি ফিরে পাওয়া সনাতন, কানু, বিশ্বজিৎ-রা বলেন, ‘‘ভগবানপুরের সেই অন্ধকার যুগের ছবি যেন সন্দেশখালিতে আবার দেখতে পাচ্ছি। টিভি ও খবরের কাগজ খুললে সন্দেশখালির সাধারণ মানুষ ও মহিলাদের উপর অত্যাচারের যে কাহিনি পড়ছি তাতে বুকটা ধড়ফড় করে উঠছে। ভাগ্য ভাল যে ভগবানপুরে সেই সব কালো দিন আমরা কাটাতে পেরেছি।’’
কাঁথি সাংগঠনিক বিজেপির জেলা সহ সভাপতি স্বপন রায়ের কথায়, ‘‘ভগবানপুরে তৃণমূলের মাফিয়ারাজ প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। সেই নান্টুর বাহিনী জেলা সহ রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় ভোটের সময় দুষ্কৃতী সরবরাহ করেতেন। ভগবানপুরের মতো সন্দেশখালিতে মানুষরুখে দাঁড়িয়েছেন।’’