গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
প্রায় আট মাস আগে স্বাস্থ্য দফতরের নির্দেশে সরিয়ে রাখা স্যালাইন (রিঙ্গার্স ল্যাকটেট) ব্যবহার করা হয়েছিল মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে। সেই স্যালাইন যে ওই হাসপাতালে মজুত ছিল, তেমনটাও নয়। বরং তা নিয়ে আসা হয়েছিল পূর্ব মেদিনীপুরের জেলা স্বাস্থ্য দফতরের রিজ়ার্ভ স্টোর (ডিআরএস) থেকে। এক প্রসূতির মৃত্যু এবং আরও দু’জনের সঙ্কটজনক হওয়ার ঘটনার প্রাথমিক তদন্তে এমনই তথ্য উঠে এসেছে স্বাস্থ্য ভবনের হাতে।
সূত্রের খবর, গত বছরের এপ্রিল থেকেই রাজ্যের কয়েকটি মেডিক্যাল কলেজ থেকে প্রসূতি-মৃত্যু ও তাঁদের সঙ্কটজনক হওয়ার খবর মিলতে থাকে। ঘটনায় ওই বিশেষ স্যালাইন ব্যবহারকেই দায়ী করতে থাকেন চিকিৎসকেরা। পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হওয়ায় গত বছরের জুন নাগাদ স্বাস্থ্য দফতর বিষয়টি বিশদে খতিয়ে দেখতে শুরু করে। দেখা যায়, ‘পশ্চিমবঙ্গ ফার্মাসিউটিক্যাল’-এর তৈরি কয়েকটি ব্যাচ নম্বরের স্যালাইন ব্যবহারে রোগী সঙ্কটজনক হয়ে পড়ছে। তখন কিছু জায়গা থেকে ওই স্যালাইনের নমুনা নিয়ে রাজ্যের ড্রাগ কন্ট্রোল রিসার্চ ল্যাবরেটরি ও কেন্দ্রের পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়। দাবি, তাতে প্রায় সব ক’টি ব্যাচই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। তবে কয়েকটির রিপোর্ট এখনও আসেনি।
জানা যাচ্ছে, রিপোর্ট না আসা ব্যাচ নম্বরের ‘রিঙ্গার্স ল্যাকটেট’ পুনরায় ব্যবহার না করে তা আলাদা করে সরিয়ে রাখতে সমস্ত মেডিক্যাল কলেজ ও জেলা স্বাস্থ্য দফতরকে নির্দেশ দেয় স্বাস্থ্য ভবন। কিন্তু বুধবার অস্ত্রোপচারের পরে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের পাঁচ প্রসূতিকে যে ‘রিঙ্গার্স ল্যাকটেট’ দেওয়া হয়েছিল, তার মধ্যে ছিল রিপোর্ট না-আসা সেই ‘২৩৯৬’ ব্যাচ নম্বরের স্যালাইনও। যা সরিয়ে রাখার নির্দেশ ছিল। ওই স্যালাইন দেওয়ার পরে পাঁচ জনই অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তিন জনের অবস্থা সঙ্কটজনক হয়। তার মধ্যে শুক্রবার সকালে মামনি রুইদাসের মৃত্যু হয়। বাকি দু’জনকে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়েছে।
বিষয়টি প্রকাশ্যে আসতেই নড়েচড়ে বসে স্বাস্থ্য ভবনও। কারণ, প্রাথমিক রিপোর্টে ‘রিঙ্গার্স ল্যাকটেট’ ব্যবহার করাকেই কারণ হিসেবে দেখানো হয়। রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের স্টোর ম্যানেজমেন্ট ইনফর্মেশন সিস্টেম বা ‘এসএমআইএস’পোর্টাল (যেখানে সমস্ত মেডিক্যাল কলেজ ও জেলা স্বাস্থ্য দফতর নিজেদের প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহের বিষয়টি নথিভুক্ত করে) পরীক্ষা করে দেখা যায়, মেদিনীপুর মেডিক্যালকে সাম্প্রতিক সময়ে ওই স্যালাইন সরবরাহ করা হয়নি। বাইরে থেকেও তাঁরা কেনেননি। তা হলে ওই ‘রিঙ্গার্স ল্যাকটেট’ এল কোথা থেকে?
সূত্রের খবর, খোঁজ নিয়ে স্বাস্থ্যকর্তারা জানতে পারেন, জুন মাসের নির্দেশ অনুযায়ী পূর্ব মেদিনীপুরের ‘ডিআরএস’-এ সরিয়ে রাখা স্যালাইন প্রয়োজন মতো আনা হয়েছিল পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ওই মেডিক্যাল কলেজে এবং সেগুলিই ব্যবহার করা হয়েছিল। ওই স্যালাইন প্রায় এক বছর আগে অর্থাৎ ২০২৪-এর একেবারে গোড়ায় জেলায় সরবরাহ করা হয়েছিল। গত নভেম্বরে ‘রিঙ্গার্স ল্যাকটেট’ নিয়ে কর্নাটক থেকে অভিযোগ পাওয়ার পরে, ১০ ডিসেম্বর ওই স্যালাইন প্রস্তুতকারী সংস্থাকে রাজ্যের ড্রাগ কন্ট্রোলের তরফে সমস্ত রকমের উৎপাদন ও সরবরাহ বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়। ওই সংস্থা ১৪ রকমের ওষুধ সরবরাহ করত সরকারকে। যার মধ্যে এই স্যালাইনও রয়েছে।
গত ৭ জানুয়ারি স্বাস্থ্য দফতর একটি নির্দেশিকায় জানিয়েছিল, ওই সংস্থার তৈরি ওষুধ সরবরাহ বন্ধ থাকায় যাতে চিকিৎসা পরিষেবা ব্যাহত না হয়, তার জন্য সমস্ত মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ এবং জেলা স্বাস্থ্য দফতর নিজেরাই সেগুলি ‘নন-ক্যাট’ ক্যাটেগরিতে ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকান থেকে বা স্থানীয় ভাবে কিনতে (লোকাল পারচেজ) পারবে।
পাশাপাশি এটাও জানানো হয়, ওই ১৪টি ওষুধের মধ্যে সাতটি ওষুধ সরবরাহ করার জন্য অন্য একটি সংস্থাকে ২৪ ডিসেম্বর ছাড়পত্র দিয়েছে রাজ্য অর্থ দফতর। সেই মতো ‘এসএমআইএস’ পোর্টালে ওই নতুন সংস্থার নাম ও তাদের সরবরাহ করা সাতটি ওষুধের তালিকা মিলবে। কিন্তু তাতে ‘রিঙ্গার্স ল্যাকটেট’ ছিল না।
সূত্রের খবর, ১০ ডিসেম্বরের পর থেকেই ‘এসএমআইএস’ পোর্টালে ‘পশ্চিমবঙ্গ ফার্মাসিউটিক্যাল’-র ১৪টি ওষুধকেই ‘ব্লক’ করে দেওয়া হয়।
২ জানুয়ারি মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ অনলাইনে ওষুধের বরাত দেওয়ার সময়ে ‘রিঙ্গার্স ল্যাকটেট’ ব্লক দেখে, তা আর বাইরে থেকে কেনেনি। বরং সেটি পাশের জেলার ভাঁড়ার থেকে আনিয়ে নিয়েছিল।কিন্তু যে স্যালাইন সরিয়ে রাখার নির্দেশ রয়েছে, তা কার কথায় মেডিক্যাল কলেজে চলে এল? স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তার জবাব, “এখনই কিছু বলব না। সবটাই খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”
এক নজরে
গত বছর এপ্রিলে পরপর প্রসূতি মৃত্যুতে কাঠগড়ায় ‘রিঙ্গার্স ল্যাকটেট’ স্যালাইন
জুন নাগাদ পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়
স্বাস্থ্য দফতর দেখে, কয়েকটি ব্যাচ নম্বরের স্যালাইনের পরেই রোগী সঙ্কটজনক
স্যালাইনটি ‘পশ্চিমবঙ্গ ফার্মাসিউটিক্যাল’-এর তৈরি
নমুনা পরীক্ষা রাজ্যের ড্রাগ কন্ট্রোল রিসার্চ ল্যাবরেটরি ও কেন্দ্রের পরীক্ষাগারে
রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত কিছু স্যালাইন ব্যবহার না করার নির্দেশ
কর্নাটকেও প্রসূতি মৃত্যু
রাজ্যে ‘পশ্চিমবঙ্গ ফার্মাসিউটিক্যাল’-কে সব উৎপাদন, সরবরাহ বন্ধের নির্দেশ
নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ২ জানুয়ারি পূর্ব মেদিনীপুর থেকে এই স্যালাইন আনে মেদিনীপুর মেডিক্যাল
এই স্যালাইন ব্যবহারের পরেই প্রসূতি মৃত্যু, দু’জন সঙ্কটজনক