চোখের জলই সম্বল একুশে জুলাইয়ের শহিদ শেখ আব্দুল খালেকের স্ত্রী কোহিনূরা খাতুনের।
জার্সি বদল গিয়েছে। কিন্তু অশান্তির ধোঁয়া আজও ছেয়ে আছে কেশপুরে।
রাজনৈতিক সংঘর্ষের বিরাম নেই। এলাকার দখল ঘিরে এখনও চলে গুলি-বোমার লড়াই। জখম হন অনেকে। মৃত্যুর মিছিলও ক্রমশ লম্বা হচ্ছে। গত লোকসভা ভোটের আগে-পরেই পাঁচটা প্রাণ ঝরেছে। তবে তা কেউ মনে রাখেনি। কেউ মনে রাখেও না। ২০১৪ সালের ২৪ এপ্রিল, ২২ মে, ২০ অগস্ট, ১০ অক্টোবর বা ২১ অক্টোবরের দিনগুলো ক্যালেন্ডারের পাতাতেই থেকে গিয়েছে।
অথচ এই দিনগুলো প্রত্যেকটাই রক্ত ঝরা। ২৪ এপ্রিল বামেদের প্রচার মিছিলে হামলা হয়। প্রাণ যায় উত্তম দোলুই নামে এক সিপিএম কর্মীর। ২২ মে ভোট পরবর্তী সংঘর্ষে তেতে ওঠে কেশপুর। প্রাণ হারান চরকার তৃণমূল নেতা ফিরোজ আলি। ২০ অগস্ট স্থানীয় জমি বিবাদে জড়িয়ে পড়ে তৃণমূলের দুই গোষ্ঠী। গুলি চলে। গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান মাজুরিয়ার তৃণমূলকর্মী গোলাম মোস্তাফা। ১০ অক্টোবর তৃণমূলের গোষ্ঠী সংঘর্ষে, টাঙ্গাগেড়িয়ায় মৃত্যু হয় স্থানীয় তৃণমূল কর্মী শেখ লখুর। ২১ অক্টোবর লোয়াদায় খুন হন তৃণমূলের জেলা পরিষদ সদস্যা কাকলি বরদোলুই।
লোকসভা ভোটের প্রচারে এসে তৃণমূলের তারকা প্রার্থী দীপক অধিকারী ওরফে দেব প্রায়ই বলতেন, “আমি যখন ছোটবেলায় কেশপুরে থাকতাম, তখন গোলমাল হত। আমি চাই কেশপুরে শান্তি থাকুক। আপনারা সবাই ভালভাবে থাকুন।’’ পালাবদলের সাড়ে চার বছর পরও সেই শান্তির খোঁজ করছে কেশপুর।
জেলা পুলিশের এক কর্তা বলছিলেন, ‘‘গোলমাল হলেই ক্ষতের উপর একটা ব্যান্ডেজ পরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। দিন কয়েক পরে ব্যান্ডেজ খুললে দেখা যাচ্ছে, ক্ষত সারেনি। তখন সে ব্যান্ডেজ ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। আসলে ক্ষতে ওষুধ না-লাগিয়ে শুধু ব্যান্ডেজ বদলে লাভ কী!”
প্রশ্ন আছে। উত্তরটা নেই।
সিপিএমের কেশপুর জোনাল সম্পাদক মানিক সেনগুপ্ত বলছেন, ‘‘কেশপুরে এখন গণতন্ত্র বিপন্ন। মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন অথচ পুলিশ উদাসীন। যেন জঙ্গলের রাজত্ব চলছে।’’ তৃণমূলের কেশপুর ব্লক সভাপতি সঞ্জয় পানের পাল্টা সওয়াল, ‘‘সিপিএমের কাছ থেকে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা শিখতে হবে না কি? বাম আমলেই কেশপুরে গণতন্ত্রকে গলা টিপে হত্যা করা হয়েছিল। বরং এখন কেশপুরের সর্বত্র মানুষ নিজের কথা বলতে পারছেন।’’
সিপিএমের জোনাল কার্যালয় জামশেদ ভবনে শহিদ বেদি।
তমাল, পারাং, কুবাই দিয়ে বয়ে গিয়েছে অনেক অনেক জল। একদা লালদুর্গ এখন সবুজগড়। এক সময়ে সিপিএমের বিরুদ্ধে ভোট লুঠের অভিযোগ উঠত, এখন সেই অভিযোগই ওঠে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। সিপিএম যে বুলি আওড়াত, সেই বুলিই শোনা যায় তৃণমূলের নেতাদের গলায়, “ওদের সঙ্গে মানুষ না-থাকলে আমরা কী করব!” ২০০১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে এই কেশপুরেই রাজ্যের মধ্যে সবথেকে বেশি ব্যবধানে এগিয়েছিল সিপিএম, ১ লক্ষ ৮ হাজার। এত বড় ব্যবধানে জয় নিয়ে কম চাপানউতোর হয়নি। তত্কালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই কত কথা বলেছেন।
কিন্তু পরিবর্তনের কেশপুর সেই রেকর্ডও ভেঙে দিয়েছে। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের তৃণমূলের লিড ১ লক্ষ ৩৩ হাজার। গত লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে তৃণমূলের লিড ১ লক্ষ ১৭ হাজার। ১৫টি গ্রাম পঞ্চায়েতের সবক’টিই শাসক দলের দখলে। পরিস্থিতির বিশেষ হেরফের না-হলে ২০০১-এর পুনরাবৃত্তিই হতে পারে ২০১৬ তে। রাজনৈতিক মহলের বিশ্লেষণ অনুযায়ী রাতারাতি ‘সংগঠনে’ ফাটল না-ধরলে ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে হয়তো রাজ্যের মধ্যে এই কেশপুরেই সবথেকে বেশি লিড পেতে পারে তৃণমূল।
তবে পরিবর্তন হয়েছে অন্য একটা জায়গায়, মনে করছে রাজনৈতিক মহল। বাম-আমলে কেশপুরে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ঘটনা তেমন বিশেষ ঘটত না। সিপিএমের নিয়ন্ত্রণ ছিল। আক্রান্ত হতেন বিরোধী দলের সমর্থকরা। কিন্তু এখন শাসকদলের সেই নিয়ন্ত্রণ নেই। ফলে, গোষ্ঠীসংঘর্ষের মাসুল দিচ্ছেন নেতা-কর্মী থেকে সাধারণ মানুষ। গত সাড়ে চার বছরে চার বার ব্লক সভাপতি বদলছে। তাও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে দাঁড়ি টানা যায়নি।
এ দিকে সিপিএমের কেশপুর জোনাল কার্যালয় জামশেদ ভবনে গৌর সাঁত, সুকুমার দাস, শেখ আনসুদ্দিনরা জানাচ্ছিলেন তৃণমূলের অত্যাচারের কথা। তাঁরা সকলেই আপাতত ঘরছাড়া। গৌর সাঁত বলছিলেন, ‘‘গত বিধানসভা নির্বাচনের পর পরিবারকে বয়কট করা হয়। তখন দশ হাজার দিতে হয়। লোকসভা নির্বাচনের পর ফের অত্যাচার শুরু হয়। ঘর ছাড়তে বাধ্য হই।’’ কেশপুরের সিপিএম নেতা নুরুল ইসলাম বলছেন, “গোটা কেশপুর জুড়ে তৃণমূলী সন্ত্রাস চলছে। তবে যত আক্রমণ হয়েছে, মানুষ তত মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছেন। আক্রমণকারীরা বিচ্ছিন্ন হচ্ছে। আগামী দিনে আরও বিচ্ছিন্ন হবে।”
পরিসংখ্যান কিন্তু অন্য কথা বলছে। সিপিএমের ১৫২টি শাখা কার্যালয়ের সবক’টি বন্ধ। ৭টি লোকাল কমিটির কার্যালয় বন্ধ। খোলা বলতে শুধু এই জোনাল কার্যালয় জামশেদ ভবন। নেতৃত্বের দাবি, এই সময়ের মধ্যে জামশেদ ভবনে তিন বার হামলা হয়েছে। ৪৩টি সাজানো মামলায় দলের ১,২৯৯ জন কর্মী- সমর্থককে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ৬৫০ জনের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করা হয়েছে। টাকার পরিমাণটা না কি ৩ কোটি ৯০ লক্ষ। ২২৫ জনের ঘরবাড়ি লুঠ করা হয়েছে। ৪০ জনের ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
তৃণমূলের জেলা কার্যকরী সভাপতি আশিস চক্রবর্তীর দাবি, ‘‘সিপিএম এখন কুত্সা, অপপ্রচার করছে। মানুষ ওদের প্রত্যাখ্যান করেছে।’’ আশিসবাবুর কাছেও মেলে খতিয়ান, ২০০০ সালে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তৃণমূল কর্মী শেখ আয়েনাল। আয়েনালের স্ত্রী আখতারুন নাহার বলছিলেন, “কোনও ভাবে দিন কেটে যাচ্ছে। ছেলে কলেজে পড়ছে। ওর একটা কাজ খুব দরকার। দেখি কি হয়।’ ১৯৯৮ সালে মারা যায় সইদুল ইসলাম। সইদুলের মা মুসলেমা খাতুন বলেন, “ওই দিনের কথাটা মনে পড়লে এখনও মন কেমন করে। ছেলেকে এ ভাবে হারাতে হবে, কখনও ভাবিনি।’’ ১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই কলকাতায় গিয়ে যাঁরা ‘শহিদ’ হয়েছিলেন, তাঁদের একজন শেখ আব্দুল খালেক। ফি বছর ২১ জুলাই আব্দুলের স্ত্রী কোহিনূরা খাতুন কলকাতায় যান। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে ডাক আসে। এখন কেমন আছেন? জল বেরোতে বেরোতে চোখ জোড়া রুক্ষ হয়ে গিয়েছে। চোয়াল শক্ত করে কহিনুরা বলছিলেন, ‘‘দিদি (মমতা) যেটুকু দিয়েছেন, সেটুকুই পেয়েছি। আর কিছু পাইনি।’’
পাওয়া, না-পাওয়া নিয়ে চাপানউতোর চলে। কেশপুরে ‘শান্তির’ আড়ালে চাপা পড়ে থাকে নিহতদের পরিজনদের কান্না। স্কুল, কলেজ, সেতু, ঝকঝকে রাস্তাও তা থামাতে পারে না। থামবেই বা কী করে? কেশপুরে যে কলেজের নবীনবরণেও গোষ্ঠী সংঘর্ষ হয়। রাস্তা তৈরি ঘিরেও গোষ্ঠী সংঘর্ষ হয়। মাদ্রাসার কমিটি গঠন ঘিরেও গোষ্ঠী সংঘর্ষ হয়। ফলে, শান্তি ফেরার নাম-ই নেই কেশপুরে।
ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।