কলকাতায় বৃহস্পতিবার নজরুল মঞ্চে তৃণমূল প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভায় শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় শিক্ষিকাদের বদলির আর্জি নিয়ে ‘স্ত্রী রোগ’-এর ‘বাহানার তথ্য তুলে ধরেন। শিক্ষামন্ত্রীর মুখে এই ধরনের ‘কুরুচিকর’ মন্তব্য নিয়ে ইতিমধ্যেই নিন্দার ঝড় উঠেছে শিক্ষক সহ নানা মহলে। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে শুরু করে সমাজের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে শিক্ষামন্ত্রীর মন্তব্যের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় বইতে শুরু করেছে।
যদিও শুক্রবার শিক্ষামন্ত্রী দাবি করেন, তাঁর মন্তব্যের অপব্যাখ্যা করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার শিক্ষিকাদের বদলির প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘‘সবাই অসুস্থ হয়ে পড়ছে। এত বেশি মহিলা শিক্ষিকা স্ত্রী রোগে ভুগছে যে আমি নিজে আতঙ্কিত হয়ে পড়ছি। এটা কী হচ্ছে? আমরা শিক্ষিকাদেরও বলেছি জেলার লোককে জেলায় দিতে। একজন শিক্ষিকা বিয়ের আগে কল্যাণীতে চাকরি করতেন। বিয়ে করে চলে গেলেন কাকদ্বীপে।এ বার বদলির কারণ কী? বর আছে বেহালায়। আমাকে বদলি করে দিতে হবে।’’
শিক্ষামন্ত্রীর এ হেন মন্তব্যকে কড়া ভাষায় নিন্দা করেছেন সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষ। সরব হয়েছেন প্রত্যেকটি শিক্ষক সংগঠনের শিক্ষিকারাও। অনেকেরই বক্তব্য, গ্রাম-গঞ্জের অনেক স্কুলেই ঠিকমতো শৌচাগার নেই। নোংরা- অপরিষ্কার শৌচাগার থেকে নানা রকম সংক্রামর রোগ ছড়ায়। এমন মন্তব্য করার পরিবর্তে শিক্ষামন্ত্রী গ্রাম-শহরের প্রতিটি স্কুলে স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার তৈরির ব্যবস্থা করলে উপযুক্ত কাজ হত।
জেলার বঙ্গীয় প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির এক সদস্য স্মৃতি পড়িয়া বলেন, ‘‘এটা আইনেই আছে শিক্ষিকারা বিয়ের পর স্বামীর বাড়িতে থাকার জন্য বদলির আবেদন করলে তা মঞ্জুর করতে হবে। অথচ এই বিষয়টিকে শিক্ষামন্ত্রী কুরুচিকর ভাষায় ব্যক্ত করলেন। আমরা অপমানিত হয়েছি। ওঁর উচিত এখনই মন্তব্য প্রত্যাহার করা। না হলে আমরা সংগঠনের পক্ষ থেকে বৃহত্তর আন্দোলনে নামব।’’
শিক্ষমন্ত্রীর এই মন্তব্যকে সমর্থন করেনি শাসক দল তৃণমূলের শিক্ষা সেলের শিক্ষিকারাও। সংগঠনের এক সদস্য সুবর্ণা মান্না বলেন, ‘‘শিক্ষামন্ত্রী আমাদের পিতৃতুল্য। উনি হয়তো খারাপ অর্থে বলতে চাননি। তবে আমার মনে হয় ওই প্রসঙ্গটি না তুললেই উনি ভাল করতেন। ওই কথায় অনেক শিক্ষিকাই ব্যথা পেয়েছেন। চারিদিকে সমালোচনার ঝড় উঠেছে।’’
শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ‘স্ত্রী রোগ’কে বাহানা বলে ‘কটাক্ষ’ করলেও বাস্তব চিত্র যে ওঁর বক্তব্যকেই সমর্থন করে তা জানিয়ে মেদিনীপুর শহরের বিশিষ্ট স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সব্যসাচী রায় বলেন, ‘‘আগের চেয়ে বর্তমান মহিলাদের নানা ধরনের স্ত্রী রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়েছে। গ্রাম থেকে শহর, সর্বত্র মহিলারা কমবেশি স্ত্রী রোগের শিকার। এর অন্যতম প্রধান কারণ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। যার মধ্যে রয়েছে নোংরা পুকুরে স্নান, অপরিষ্কার শৌচলয় ব্যবহার ইত্যাদি।’’
জেলার অনেক হাইস্কুলগুলিতে শিক্ষক-শিক্ষিকা, ছাত্র ও ছাত্রীদের ব্যবহারের জন্য আলাদা আলাদা শৌচালয় থাকলেও এমনও স্কুল রয়েছে যেখানে এমন ব্যবস্থা অপ্রতুল। বিশেষ করে প্রাথমিকের ক্ষেত্রে ছাত্রীদের জন্য পৃথক শৌচালয় থাকলেও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের জন্য আলাদা শৌচালয়েপ ব্যবস্থা প্রায় থাকেই না।
এই বিষয়ে পাঁশকুড়ার উখড়াপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা কৃষ্ণা মণ্ডল সাহু বলেন, ‘‘স্কুলে ছাত্রীদের বাথরুম ব্যবহার করা সত্যি কষ্টের। কারণ শিশুরা সব সময় শৌচাগার ব্যবহার করে ঠিকঠাক জল পর্যন্ত দেয় না। মহিলাদের ঋতুর সময় একই শৌচাগার ব্যবহার করা যায় না। ফলে এই ধরনের শৌচাগার থেকে রোগ সংক্রমণের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’’ তাঁর মতে, হাইস্কুলের মতো প্রাথমিকেও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের জন্যও পৃথক শৌচাগার থাকা দরকার। এর জন্য সরকারের উচিত অর্থ বরাদ্দ করা।’’
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার শিক্ষা কর্মাধ্যক্ষ মধুরিমা মণ্ডল বলেন, ‘‘এই দাবি অমূলক নয়। সরকার বিভিন্নভাবে উন্নয়ন করছে। প্রাথমিকে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের জন্য পৃথক শৌচালয় তৈরিতে আগামীদিনে নিশ্চয়ই উদ্যোগী হবে সরকার।’’
শিক্ষামন্ত্রীর মন্তব্যের সমালোচনায় মুখর বিজেপিও। দলের তমলুক সাংগঠনিক জেলার সভাপতি নবারুণ নায়েক বলেন, ‘‘যে দলের মুখ্যমন্ত্রী একজন মহিলা সেই দলের শিক্ষামন্ত্রী কী করে শিক্ষিকাদের উদ্দেশ্যে এমন মন্তব্য করেন? ওঁকে ওই পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া উচিত। আসলে উনি মুখ্যমন্ত্রীর অনুপ্রেরণায় ওই মন্তব্য করেছেন।’’