মঞ্চে পার্থ চট্টোপাধ্যায়
উৎসবের আবহ ছিলই। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরুর আগে তৈরি হয়ে গিয়েছিল সৌজন্যের আবহও। কিন্তু কোনও পক্ষই তা কাজে লাগালেন না।
বুধবার ঝাড়গ্রামে রাজ্যস্তরের জঙ্গলমহল উৎসবের উদ্বোধনে আমন্ত্রণ না পেলেও এ দিন উৎসব প্রাঙ্গণে এসেছিলেন ঝাড়গ্রামের বিজেপি সাংসদ কুনার হেমব্রম। তবে তাঁকে মঞ্চে ডাকা হল না। মঞ্চের নীচে সাধারণ আসনে পারিষদ পরিবৃত হয়ে ঠায় চল্লিশ মিনিট বসে থাকেন তিনি। সাংবাদিকদের সামনে শাসকদল ও প্রশাসনের বিরুদ্ধে সরব হলেন। সাংসদ চলে যাওয়ার পরে উৎসব স্থলে আসেন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। এমন ঘটনার জেরে এ দিন নির্ধারিত সময়ের এক ঘণ্টা পরে শুরু হল উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। উৎসব মঞ্চেও প্রাধান্য পেল রাজনীতিই। সেখানে নাম না করে শুভেন্দু অধিকারীকে কটাক্ষ করলেন পার্থ ও অনুষ্ঠানের অন্যতম অতিথি (বিশিষ্ট সমাজসেবী হিসেবে পরিচয় দেওয়া হয়) ছত্রধর মাহাতো।
বুধবার ঝাড়গ্রাম শহরের ননীবালা স্কুল মাঠে বিকেল তিনটে নাগাদ উৎসব প্রাঙ্গণে হাজির হন কুনার। সাধারণ দর্শকাসনের দ্বিতীয় সারিতে গিয়ে বসেন তিনি। সেখানে বসে এক বিক্রেতার কাছ থেকে কফি কিনেও খান সাংসদ। সংবাদমাধ্যমকে দেখে কুনার বলেন, ‘‘আমি জনপ্রতিনিধি। মেজরিটি মানুষ আমার সঙ্গে রয়েছেন। অথচ সেই সব মানুষের মর্যাদা দিতে রাজি নয় রাজ্য সরকারের এই প্রশাসন। ছত্রধরকে সমাজসেবী তকমা দিয়ে মঞ্চে ডাকা হয়েছে। আমি সাংসদ অথচ আমাকে ডাকার সৌজন্যটুকুও নেই ওঁদের। কোটি কোটি টাকার মোচ্ছব হচ্ছে। এই মেলা-উৎসব না করে শিক্ষামন্ত্রী যদি আদিবাসী মাধ্যম স্কুলের জন্য দু’টো শ্রেণিকক্ষের উদ্বোধন করতেন তাহলে আমি খুশি হতাম।’’ তিনি জোড়েন, ‘‘ উৎসবে ধামসা-মাদল না দিয়ে যদি আদিবাসী পড়ুয়াদের মাতৃভাষায় পাঠ্যপুস্তক দিতেন তাহলে জঙ্গলমহলের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়ার সুযোগ পেত। সে সব না করে কোটি কোটি টাকা কাটমানির জন্য উৎসব হচ্ছে। এখনও অনেক এলাকায় রাস্তা নেই, পানীয় জল নেই।’’ মিনিট চল্লিশ বসে থাকার পরে উৎসব প্রাঙ্গণ থেকে বেরিয়ে যান সাংসদ। বেরোনোর সময় বলেন, ‘‘আমি আছি বলে মন্ত্রী আসতে পারছেন না। প্রশাসনের অসুবিধা হচ্ছে। তাই আনন্দ মাটি করতে চাই না। ওঁরা অনুষ্ঠান করুন। উৎসবে আগত লোকশিল্পীরাও ভাল করে অনুষ্ঠান করুন। তাই আমি চলে যাচ্ছি।’’
সপ্তম বর্ষ জঙ্গলমহল উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের সময় ছিল বিকেল তিনটে। তার অনেক আগেই হাজার খানেক লোকশিল্পী লোকনৃত্য শুরু করে দিয়েছিলেন। পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদ ও জেলা প্রশাসনের আধিকারিকেরাও এক একে হাজির হতে থাকেন। পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদের ভাইস চেয়ারমান দুলাল মুর্মু, প্রাক্তন তৃণমূল সাংসদ উমা সরেন-সহ রাজ্যের শাসকদলের কয়েকজন জনপ্রতিনিধিও পৌঁছে যান। এ দিন পুরুলিয়ার ভার্চুয়াল সভা থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঝাড়গ্রাম জেলার ৩৩ টি প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। মুখ্যমন্ত্রীর উদ্বোধনের পরে গোপীবল্লভপুরে গিয়ে গৌড়ীয় সেতুর উদ্বোধন করেন পার্থ। এরপরে ঝাড়গ্রামে এসে সার্কিট হাউসের দ্বারোদ্ঘাটন করেন তিনি। প্রশাসন সূত্রে খবর, সেখানেই দুপুরের খাওয়া সেরে উৎসব স্থলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু সাংসদ উৎসবস্থলে রয়েছেন জেনে পার্থ সার্কিট হাউসে অপেক্ষা করতে থাকেন। ৩টে ৪০ নাগাদ সাংসদ চলে যান। বিকেল চারটেয় মঞ্চে আসেন পার্থ, ছত্রধর সহ জেলার বাকি জনপ্রতিনিধি ও শাসকদলের লোকজন। আসেন জেলাশাসক ও পুলিশ সুপার।
ছত্রধর এ দিন বলেন, ‘‘বহিরাগতেরা এসে নিজেদের জঙ্গলমহলের মুক্তিসূর্য বলে জাহির করছে। আপনারা তাঁদের চিনে রাখুন। তাঁরা আপনাদের লুটেপুটে খাওয়ার জন্য আসতে চাইছে, যেমন এগারো বছর আগে জঙ্গলমহলে আমরা দেখেছিলাম।’’ জঙ্গলমহলে উন্নয়নের খতিয়ান দিয়ে পার্থের দাবি, ‘‘এখানে অনেক বীরপুঙ্গব আছেন, তাঁরা এখন বীরের ভূমিকা পালনের চেষ্টা করছেন। বলছেন আমরা সব বীর ছিলাম। আসল বীর এই এলাকার মানুষ। তাঁরাই পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। সেই সব মানুষের নেতৃত্ব দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।’’
সাংসদ এলেও তাঁকে মঞ্চে ডাকা হল না কেন? সাংবাদিকদের এই প্রশ্নের উত্তরে পার্থ দাবি করেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীও বহু অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণই পান না। সেখানে উনি আর কী দাবি জানাবেন। আমি আয়োজক নেই। আমিও আমন্ত্রিত।’’
কুনারকে তোপ দেগেছে জেলা তৃণমূলও। জেলা তৃণমূলের সভাপতি তথা পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদের ভাইস চেয়ারম্যান দুলাল মুর্মুর দাবি, ‘‘দেশে করোনা যখন ঊর্ধ্বগতি ছিল তখন রাম মন্দিরের শিলান্যাসের নামে ধর্মীয় উৎসব-উচ্ছ্বাস হয়েছিল। সরকারি আয়োজনে জঙ্গলমহলের বিভিন্ন জনজাতি ও তাঁদের সংস্কৃতির প্রসারের লক্ষ্যেই জঙ্গলমহল উৎসবের আয়োজন করা হয়। জঙ্গলমহলের সার্বিক উন্নয়নের প্রতিফলনও পাওয়া যায় এই উৎসবে।’’