রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়েছে অধিকাংশ ম্যানগ্রোভ। নিজস্ব চিত্র keshabmanna23@gmail.com
১০০ দিনের কাজের টাকা কবে পাওয়া যাবে তা অনিশ্চিত। ফলে রক্ষণাবেক্ষণ বন্ধ। যার প্রভাব পড়েছে ম্যানগ্রোভে। লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে লাগানো ম্যানগ্রোভ নষ্ট হতে বসেছে। গোটা প্রকল্পই এখন বিশ বাঁও জলে।
দু'বছর কেটে যাওয়ার পরেও ইয়াসের ক্ষত এখনও দগদগে উপকূল জুড়ে। আমপান, ইয়াসের অভিজ্ঞতা থেকে দিঘা-সহ বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী এলাকায় বাঁধের ভাঙন রোধ-সহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মোকাবিলায় ম্যানগ্রোভের গুরুত্বের কথা বার বার উঠে এসেছে। প্রতি বছর বিভিন্ন সময়ে নানা কর্মসূচির অঙ্গ হিসেবে সরকারের তরফে ম্যানগ্রোভ রোপণ করা হয়। ধুমধাম করে বহু টাকা ব্যয়ে ম্যানগ্রোভ রোপণ করা হলেও বছর ঘোরার আগেই তার মৃত্যু ঘটছে। যে উদ্দেশ্য নিয়ে ম্যানগ্রোভ রোপণ হচ্ছে, তার সুফল অধরাই থেকে যাচ্ছে।
স্থানীয় সূত্রের খবর, বেশিদিন হয়নি রামনগর সহ কাঁথি মহকুমার বিভিন্ন ব্লকে সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকা এবং নদীর চরে ম্যানগ্রোভ রোপণ করা হয়েছিল। তবে বর্তমানে অনেক জায়গাতেই দেখা যাচ্ছে, সে সবের অনেকই অবশিষ্ট নেই। কোথাও আবার কয়েক হাজার চারার মধ্যে বেঁচে রয়েছে সামান্য কিছু। রামনগর-১ ব্লকের পদিমা-২ পঞ্চায়েত এলাকার সমস্ত সমুদ্রবাঁধ বিপজ্জনক। দিঘা মোহনার অদূরে মৈত্রাপুর, বেগুনাডিহা এবং আটিলি গ্রামের চরে ২০২১ সালে সরকারি ভাবে কয়েক হাজার ম্যানগ্রোভ চারা লাগানো হয়েছিল। সেখানে গিয়ে দেখা গেল, কিছু কিছু অংশে গাছের কোনও অস্তিত্বই নেই। চারদিকের শুধু কাঁটা তারের বেড়াটাই রয়েছে।
এই পঞ্চায়েতের কিছুটা দূরে সমুদ্রের কোল ঘেঁষে কয়েক বছর আগে ম্যানগ্রোভের চারা লাগানো হয়েছিল। জাল ও বেড়া দিয়ে ঘিরেও দেওয়া হয়। তবে এখন না আছে জাল, না আছে চারা। হাতে গোনা কিছু কাঁকড়া জাতীয় ম্যানগ্রোভ গাছ জোয়ারের সময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে উঁকি মারছে। স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, ‘‘এখানে চারা লাগানোর কয়েক দিনের মধ্যেই তা মরে যেতে শুরু করে। রক্ষণাবেক্ষণ কিছু করতে দেখিনি।’’ একই অবস্থা দিঘায় প্রবেশ পথের পাশ দিয়ে যে মেরিন ড্রাইভের রাস্তা ন্যায় কালী মন্দিরের দিকে চলে গিয়েছে, সেই রাস্তায় কংক্রিটের বাঁধের ধারে লাগানো কাঁকড়া, গেঁওয়া, সুন্দরী এবং গামা গাছের জঙ্গলের। গোটা জায়গাটাই প্রায় ফাঁকা।
পদিমা গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় অবশ্য প্রাকৃতিকভাবে কিছু কাঁকড়া জাতীয় ম্যানগ্রোভের গাছ বড় হয়েছে। রোপণ করা গাছ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, অনেক সময়ে গবাদিপশুরা বেড়া ভেঙে দেয়। ভাঙা জায়গা দিয়ে ছাগল-সহ অন্যান্য পশু ঢুকে চারা নষ্ট করে। পদিমা-২ পঞ্চায়েতের বিদায়ী প্রধান মৃণ্ময়ী প্রধান বলেন, ‘‘কিছু কিছু ম্যানগ্রোভ নষ্ট হয়েছে বিভিন্ন কারণে। রোপণের সময় কিছু কিছু মরা ম্যানগ্রোভ চারা লাগানো হয়েছিল। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলারা রক্ষণাবেক্ষণ করতেন। ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে তাঁদের টাকা পাওয়ার কথা। কিন্তু মজুরি বাবদ সেই টাকা তারা পাচ্ছেন না। ফলে রক্ষণাবেক্ষণ পুরোপুরি বন্ধ। তবে অনেক জায়গায় ম্যানগ্রোভ বেঁচে আছে। ’’আগামী ২৮ জুলাই বিশ্ব ম্যানগ্রোভ দিবস। জেলা ব্যাপী শুরু হয়েছে অরণ্য সপ্তাহ পালন কর্মসূচি। এরই মধ্যে উপকূলের রক্ষাকর্তা ম্যানগ্রোভের এমন পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন সেখানকার বাসিন্দারা।
পরিবেশবিদ সুদীপ্ত ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘নদীর চরে বীজ ছড়ানোর থেকে চারা লাগানো বেশি কার্যকর।’’ ব্লক প্রশাসন সূত্রে খবর, এক একর জমিতে ম্যানগ্রোভ বীজ লাগাতে সব মিলিয়ে খরচ ধরা হয় প্রায় ২ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা। এর মধ্যে প্রায় ৩০ হাজার টাকা খরচ হয় বীজের জন্য। বাকি টাকা বীজ রোপণ, বেড়া দেওয়া-সহ রক্ষণাবেক্ষণে খরচ হয়। বন দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে-ম্যানগ্রোভ রোপণ কর্মসূচি সফল করতে ন্যূনতম তিন বছর লাগে। এক্ষেত্রে একশো দিনের কাজের প্রকল্পে দেড় বছর ধরে কোন অর্থ বরাদ্দ করা হয়নি। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে প্রাপ্য টাকা মেলেনি বলে অভিযোগ করে আসছে রাজ্য সরকার। তার ফলে মার খাচ্ছে পূর্ব মেদিনীপুরের উপকূল এলাকায় ম্যানগ্রোভ রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যার কাজ।
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার বনাধিকারিক অনুপম খান বলছেন,"বন দফতর সরাসরি যে সব জায়গায় ম্যানগ্রোভ রোপণ করেছে সেখানে রক্ষণাবেক্ষণ কিংবা পরিচর্যা সঠিকভাবেই হচ্ছে। তবে, যে সব এলাকায় একশো দিনের কাজের প্রকল্পে ম্যানগ্রোভ লাগানো হয়েছিল সেখানে সরকারি বরাদ্দ মেলেনি। তাই পরিচর্যা সম্ভব হচ্ছে না। ম্যানগ্রোভের চারা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যাতে বিকল্পভাবে অর্থ বরাদ্দ করা হয় তার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানিয়েছি।’’