দম শেষ হয়ে আসছিল। হাঁসফাঁস করছিলাম। হঠাৎ বহু দূরে জোনাকির মতো অনেক আলো দেখতে পেয়েছিলাম। অত কষ্টের মধ্যেও মনে কোথাও যেন জেগে উঠেছিল আশার আলো। ফিরে এসেছিল সমুদ্রের নোনা জলে সঙ্গে লড়াই করার ক্ষমতা।
শনিবার গভীর রাতে যখন শঙ্করপুর মৎস্য বন্দর থেকে মাছ ধরতে রওনা হয়েছিলাম, তখনও জানতাম না আগামী কয়েক ঘণ্টায় আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে। রাত ৩টের দিকে বরফ, তেল, নতুন জাল নিয়ে সমুদ্রে রওনা হই। লঞ্চে আমি ছাড়াও আরও পাঁচ জন মৎস্যজীবী ছিলেন। দিঘার সমুদ্রের বড় জোর ঘণ্টা পাঁচ-ছয় লঞ্চ চালিয়ে আমরা এক জায়গায় গিয়ে মাছ ধরছিলাম। হঠাৎ মাঝি জানালেন, ইঞ্জিন খারাপ হয়ে গিয়েছে।
সকলে মিলে ইঞ্জিন মেরামত করে কোনও রকমে পাড়ে ফেরার চেষ্টা শুরু করেছিলাম আমার। কিন্তু সেই চেষ্টা তো সফল হলই না। উল্টে লঞ্চের তলায় একটা ফুটো দিয়ে সমুদ্রের জল ঢুকতে শুরু করল। কী করব— ভয়ে, আতঙ্কে তখন কিছুই বুঝেতে পারছিলাম না। অগত্যা সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম, সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে দেব। সেই মত লঞ্চে থাকা একটা তেলের ব্যারল নিয়ে আমরা মাঝ সমুদ্র ঝাঁপ দিয়েছিলাম।
সকলে কে কোথায় বুঝতে পারেনি। তবে আমার তিন জন কয়েক ঘণ্টা ধরে অশান্ত সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল, আর কখনও হয়তো পরিবারকে দেখতে পাবো না। তবে কোনও রকমে হাত-পা ছুঁড়ে আমি, শঙ্কর আর নন্দ— তিনজনে মিলে সাঁতার কেটে গিয়েছি। এক সময় সূর্য ডুবল। অন্ধকারে কোথায় যাচ্ছি, কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আরও কয়েক ঘণ্টা পরে দূরে প্রচুর আলো দেখতে পেলাম।
ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। তবে আলো দেখে মনে জোর আসতে শুরু করেছিল। জনপদে যে কোনও ভাবে পৌঁছনোর জন্য শেষ চেষ্টা করেছিলাম আমরা তিনজন। সৈকতে যখন পৌঁছেছিলাম, তখন ঠিকমতো নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম না। শুধু সমুদ্রের ধারে বাংলা অক্ষরে লেখা ‘দিঘা থানা’টি চোখে পড়েছিল। তখন পড়েছিল স্বস্তির নিঃশ্বাস।
পুলিশ এবং স্থানীয়েরা আমাদের তিনজকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসার পরে এখন কিছুটা সুস্থ। কিন্তু সমুদ্রে গত ৯-১০ ঘণ্টায় যে লড়াইটা আমাদের করতে হয়েছে, সে টা যেন আরও কখনও করতে না হয়।