শ্রদ্ধা: বিরসা মুন্ডার মূর্তির সামনে মুখ্যমন্ত্রী। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।
উপলক্ষ যাই থাকুক না কেন, তাঁর সভা থেকে মেলে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক দিশা। কিন্তু এ বার তা মিলল না।
পঞ্চায়েত ভোট থেকে মন্ত্রী অখিল গিরির মন্তব্য, কিংবা আদিবাসী ও জনজাতির বিভিন্ন গোষ্ঠীর দাবিদাওয়া—কোনও কিছু নিয়েই বার্তা দিলেন না মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মঙ্গলবার বিরসা মুন্ডার জন্মদিনে বেলপাহাড়ির সাহাড়ি মাঠের প্রশাসনিক জনসভায় মুখ্যমন্ত্রী একশো দিনের কাজ, গরিব মানুষের বাড়ি ও রাস্তার টাকা না দেওয়ায় কেন্দ্রের সমালোচনা করেছেন। তাঁর আমলে জঙ্গলমহলের সার্বিক উন্নয়নের ফিরিস্তি শুনিয়েছেন। ব্যস এতটুকুই। সাম্প্রতিক ঘটনাবলি নিয়ে নেই কোনও প্রতিক্রিয়া। কেন্দ্রীয় সরকারের সমালোচনা করলেও সে ভাবে বিজেপির বিরুদ্ধেও আক্রমণ শানাননি তিনি। আর সিপিএম তো মুখ্যমন্ত্রীর আক্রমণের তালিকা থেকে একেবারে বাদ।
রাজনৈতিক মহলের একাংশের অনুমান, সম্ভবত, কৌশলগত কারণেই মুখ্যমন্ত্রী সংযত বক্তৃতা করেছেন। কারণ তিনি ভালই জানেন, পঞ্চায়েত ভোটের আগে কুড়মি ও বিভিন্ন জনজাতি সংগঠন প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির তুল্যমূল্য হিসেব নিকেশ কষছে। সেখানে কুড়মি ও আদিবাসীদের অপ্রাপ্তির পাল্লাটাই ভারী। জঙ্গলমহলে সাঁওতাল, মুন্ডা, ভূমিজ, কোড়া সহ নানা আদিবাসী জনগোষ্ঠী রয়েছে। সাঁওতালদের পরেই রয়েছে মুন্ডারা। যদিও মুন্ডাদের বক্তব্য, তাঁদের মুন্ডারি ভাষার রাজ্যের দ্বিতীয় সরকারি ভাষার স্বীকৃতি, মাতৃভাষায় স্কুলস্তরে শিক্ষার অধিকার, আদিবাসী অ্যাভাইজারি কাউন্সিলে মুন্ডা প্রতিনিধি রাখা, পৃথক মুন্ডা উন্নয়ন পর্ষদ, সংস্কৃতির সংরক্ষণের দাবিগুলি আজও উপেক্ষিত। ‘ভারত মুন্ডা সমাজ’এর পশ্চিমবঙ্গ শাখার সংগঠন সম্পাদক হিমাংশু সিং বলছেন, ‘‘আশা ছিল মঞ্চ থেকে মুখ্যমন্ত্রী আমাদের দাবি গুলি সম্পর্কে কিছু ঘোষণা করবেন। কিন্তু তিনি কিছুই বললেন না।’’
আদিবাসী ভূমিজদেরও নানা দাবি রয়েছে। ভূমিজ ভাষাকে রাজ্যের দ্বিতীয় ভাষার স্বীকৃতি, ভূমিজ বিদ্রোহের মহানায়ক গঙ্গানারায়ণ সিং ও চুয়াড় বিদ্রোহের শহিদ রঘুনাথ সিংয়ের সরকারি উদ্যোগে মূর্তি স্থাপন ও তাঁদের জন্মদিনে সরকারি ছুটি ঘোষণা, পৃথক আদিবাসী ভূমিজ উন্নয়ন পর্ষদ গঠন সহ নানা দাবিতে গত চার বছর ধরে প্রশাসনিক মহলে দাবি সনদ দিয়ে চলেছে ভূমিজদের ‘সামাজিক ভারতীয় আদিবাসী ভূমিজ সমাজ’। সংগঠনের সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি তপনকুমার সর্দার বলছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী এলাকায় এলেন। অথচ ভূমিজদের দাবি নিয়ে কোনও শব্দ খরচ করলেন না। সরকার আমাদের ব্রাত্য করে রেখেছে।’’
পুজোর আগে পাশের জেলা পশ্চিম মেদিনীপুরের খেমাশুলিতে টানা পাঁচদিন রেল ও জাতীয় সড়ক অবরোধ করেছিল বিভিন্ন কুড়মি সংগঠনের মিলিত মঞ্চ ‘ছোটনাগপুর টোটেমিক কুড়মি/কুরমি মাহাতো সমাজ’। কুড়মিদের আদিবাসী তালিকাভুক্তির স্বপক্ষে কেন্দ্রের কাছে সিআরআই (কালচারাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট) রিপোর্ট পাঠানোর জন্য তিন মাস সময় নিয়েছে রাজ্য। ইতিমধ্যে একমাস পেরিয়ে গিয়েছে। ওই রিপোর্ট এখনও পাঠানো হয়নি বলেই দাবি কুড়মি সংগঠনগুলির। আদিবাসী জনজাতি কুড়মি সমাজের রাজ্য সভাপতি শিবাজি মাহাতো বলছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর এখন শ্যাম রাখি না কুল রাখি অবস্থা। সবার উন্নয়ন করবেন বলে আশ্বাস দিয়ে এখন কারও জন্য আর কিছুই করতে পারছেন না। তাই হয়ত চুপ থেকেছেন।’’ বিজেপির জেলা সহ-সভাপতি দেবাশিস কুণ্ডুর কটাক্ষ, ‘‘আদিবাসী উন্নয়নের কাজ হয়নি। সেই কারণেই আদিবাসী ও কুড়মিদের নির্দিষ্ট দাবিগুলি সম্পর্কে তিনি চুপ থেকেছেন।’’
জেলা তৃণমূলের সভাপতি দুলাল মুর্মুর জবাব, ‘‘বিজেপিই বিভাজনের রাজনীতি করে। তাই ওরা এসব বলছে। মুখ্যমন্ত্রীও সবার কথা ভাবেন। সবাইকে সমান চোখে দেখেন। তিনি জঙ্গলমহলের উন্নয়নের কাণ্ডারী।’’