পুজোয় গন্তব্য হিজলি, সমস্যা সৈকতের নোংরা

সমুদ্র সৈকতে ক্লান্তি আসে না। কিন্তু চেনা সৈকতে কি বারবার যেতে ভাল লাগে! পুজোর সফরে বদলানো যেতে পারে সৈকত।

Advertisement

কেশব মান্না

শেষ আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ২৩:৫৬
Share:

পেটুয়াঘাট মৎস্য বন্দরের কাছে। (ডানদিকে) নোংরা ভরা হিজলির সৈকত। নিজস্ব চিত্র

পরোপকার করতে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলেন নবকুমার। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসের নায়ক। তাঁর হারিয়ে যাওয়ার সেই স্থান তো রসুলপুর নদীর তীর। বঙ্কিমের উপন্যাসের বর্ণনার বালিয়াড়ি অনেকদিনই সমুদ্রে হারিয়েছে। তবে রসুলপুর নদীর মোহনা এখনও সুন্দর। নৈসর্গিক দৃশ্য অসাধারণ। বঙ্গোপসাগরের তীরের এই সৈকত এখন বহু পর্যটকের গন্তব্যস্থল। সেই সঙ্গেই দেখা যেতে পারে ইতিহাস ও সম্প্রীতির অনন্য নিদর্শন। কাছেই রয়েছে একটি মৎস্য বন্দর। জাহাজের সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে থাকা, মৎস্য শিকারের পরে ফেরা, অপূর্ব দৃশ্য সেসব।

Advertisement

এবার পুজোয় রসুলপুর নদীর মোহনায় অবস্থিত হিজলি ঘুরে দেখা যেতেই পারে। চোখে না দেখলে তা বর্ণনায় উপলব্ধি করা যায় না। পূর্ব মেদিনীপুরে অবস্থিত হিজলি। কাঁথি থেকে মুকুন্দপুর হয়ে পেটুয়া ঘাট যেতে পারেন অটো বা ট্রেকারে চেপে। সেখান থেকে লঞ্চে চেপে পৌঁছে যাওয়া যায় হিজলি। এই রাস্তার সর্বাধিক দূরত্ব ১৪ কিলোমিটার। ৫ টাকার বিনিময়ে মিলবে লঞ্চের টিকিট। লঞ্চে উঠে রসুলপুর নদী পেরিয়ে সুন্দর আর সুন্দরের ছবি ভরা হিজলি পৌঁছে যাবেন। সেখান থেকে টোটো কিংবা অটো রয়েছে। তিন চাকার গাড়িতে চেপে মোরাম এবং ইটের রাস্তা ধরে রসুলপুর নদীর মোহনা যাওয়া যায়।

জায়গাটার একটু বর্ণনা দেওয়া যাক। একদিকে রসুলপুর নদীর মোহনা এবং বঙ্গোপসাগরের ঢেউ। তার পাশে রয়েছে অজস্র নোনামাটিতে শোভা ম্যানগ্রোভ জঙ্গল। কয়েক হাত দূরে পাতাবিহীন শুকনো গাছ সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। উল্টোদিকে ধু-ধু বালি। আর সারি সারি ঝাউ গাছ। একপাশে বেশ কিছুটা এলাকা জুড়ে কাশফুল ফুটেছে। এক ঝলকে শারদ শোভায় ভরা সৈকত দেখে মন ভরে উঠবে। বিস্তীর্ণ সৈকতে দিনের বেলায় বিক্ষিপ্তভাবে পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে। চলে বিকিকিনিও। কয়েকটি আইসক্রিমের দোকান রয়েছে আশেপাশে। ভাটার সময় পর্যটকেরা বালি-কাদা পায়ে হেঁটে খানিকটা এগিয়ে যাযন। দেখা মেলে সমুদ্র আর রসুলপুর নদীর মোহনা। তবে জোয়ারের সময় অনেকটাই জল জনবসতির দিকে এগিয়ে আসে। তখন কিন্তু ঢেউয়ের আনন্দ নিতে জলে স্নান করতে নামেন পর্যটকেরা। সমুদ্রের ঢেউ অত্যন্ত শান্ত হওয়ায় এখানে স্নান করার ক্ষেত্রে কোনও ঝুঁকি থাকে না।

Advertisement

পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কাঁথি মহকুমার অন্তর্গত খেজুরি থানার মধ্যে পরে হিজলি। সৈকত জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে প্রচুর বালি। সৈকতে যা স্বাভাবিক। তবে সেই বালি বেশ খানিকটা শক্ত হয়ে গিয়েছে। কারণ অবিরাম সৈকতের উপর পর্যটকেরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আবার অনেক সময় মোটরবাইক চেপে সৈকত দাপিয়ে বেড়াযন পর্যটকেরা। এলাকার বাসিন্দারা জানান, বাইকের দাপট মাঝে মাঝেই পর্যটকদের বিপদের কারণ হয়। কিন্তু প্রশাসনের কোনও নজরদারি নেই বলে অভিযোগ। অনেকে প্রশাসনকে জানিয়েছেন। কিন্তু কাজ হয়নি।

সৈকতে সৌন্দর্যে মন ভরলে করা যেতে পারে ইতিহাস দর্শন। সৈকতের পরে ঝাউবন পেরিয়ে কয়েক পা পেরোলেই হিজলির মসনদ-ই-আলা শরিফ। এক ঐতিহাসিক এবং ধর্মীয় ক্ষেত্র। সব ধর্মের মানুষ এই ধর্মীয় ক্ষেত্র দর্শনে আসেন। এখানে চৈত্র মাসে বড় মেলা বসে। তবে ধর্মীয় স্থান হওয়ার কারণে সারা বছর পুণ্যার্থীদের আগমন ঘটে। তার জন্য মসনদ-ই-আলার পিছনে ঝাউবনের ভিতর অসংখ্য দোকান তৈরি হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা খেলনা থেকে খাবার, নানারকমের দোকান বসিয়েছেন। উত্তর ২৪ পরগনার দেগঙ্গা থেকে এসেছিলেন মহম্মদ ইউসুফ। তিনি বললেন, ‘‘সপরিবার বাসে চেপে এসেছিলাম। তবে ধর্মীয় স্থান ঘুরে দেখার পর এরকম নৈসর্গিক পরিবেশ দেখতে পাব স্বপ্নেও ভাবিনি।’’ যাঁরা লঞ্চ পেরিয়ে হিজলি যেতে ভয় পান, তাঁরা সড়কপথে হেঁড়িয়া থেকে বিদ্যাপীঠ মোড় হয়ে বাস এবং অটোতে চেপে যেতে পারেন। স্থানীয় বাসিন্দা রামচন্দ্র মণ্ডলের কথায়, ধর্মীয় স্থান হিসেবে সারা বছর পুণ্যার্থীরা আসেন। তবে ইদানীং এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ দেখার জন্য পর্যটকেরাও আসেন। দূরদূরান্ত থেকে আসা পর্যটকদের থাকার মতো সেরকম সরকারি উদ্যোগে কোনও অতিথি নিবাস নেই বললেই চলে। তবে স্থানীয় উদ্যোগে দু’টি বড় লজ গড়ে উঠেছে। এছাড়া ওই এলাকায় কয়েকটি ব্যক্তিগত ছোট মাপের গেস্ট হাউস তৈরি হয়ে গিয়েছে।

পর্যটকদের আগমন বাড়ায় এলাকার উন্নয়নে নজর দিয়েছে প্রশাসনও। কয়েক বছর আগে বিধায়ক তহবিল থেকে মসনদ-ই-আলার কাছে হাইমাস্ট পথবাতি বসানো হয়েছে। পর্যটক এবং পুণ্যার্থীদের কথা বিবেচনা করে শৌচাগার বানানো হয়েছে। কিন্তু সৈকত জুড়ে চরম অবস্থা। সেখানকার ব্যবসায়ীরা জানালেন, সন্ধ্যের পর সৈকতে কিন্তু অন্ধকার নেমে আসে। সেখানে কোনও আলোর ব্যবস্থা নেই। তাই পর্যটকেরা একেবারেই আসেন না। ফলে সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে সৈকত ছাড়তে হয় পর্যটকদের। তবে শুধু অন্ধকার নয় হিজলির সমুদ্র সৈকত অপরিচ্ছন্ন। যত্রতত্র নোংরা আবর্জনায় ভরে গিয়েছে সৈকত।

বালি, ম্যানগ্রোভ জঙ্গল আর ঝাউবন দেখার জন্য ইদানিং প্রচুর পর্যটক ভিড় জমান। হিজলিতে সমুদ্র সৈকত এবং মসনদ-ই-আলা ছাড়াও বহু প্রাচীন নিদর্শন রয়েছে কাছাকাছি এলাকায়। রয়েছে ভারতের সবচেয়ে পুরনো ডাকঘর। লাইট হাউস, ডাকবাংলোর মতো ধ্বংসপ্রাপ্ত অসংখ্য পুরনো কালের নিদর্শন।

প্রকৃতির টানে হিজলি ঘুরতে যেতে চাইলেও অসুবিধা কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা। আর আর থাকার মতো সরকারি বন্দোবস্তের অভাব। সেখানকার পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি অসীম মণ্ডলের দাবি, ‘‘আমরা সৈকত বানানোর জন্য এবং সেখানে পথবাতি বসানোর জন্য জেলা প্রশাসনের কাছে আবেদন জানিয়েছি। তবে হিজলিকে দিঘার মত পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ব্লক প্রশাসন সব সময় সক্রিয়।’’ কিন্তু সৈকত কেন নোংরা থাকে? সে বিষয়ে পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি জানিয়েছেন, জায়গায় জায়গায় ডাস্টবিন বসানো হলেও পর্যটকেরা তা ব্যবহার করতে নারাজ। কিন্তু পরিষ্কারের ব্যবস্থা তো করা যায়? এ বিষয়ে সমিতির বক্তব্য, হিজলি নিয়ে রাজ্য সরকারের চিন্তাভাবনা রয়েছে। তাই স্থানীয় প্রশাসন আলাদা করে কিছু ভাবেনি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement