চাষিদের কাছ থেকে ধান কিনে মজুদ করে রেখেছেন ব্যবসায়ীরা । দাসপুরে। —নিজস্ব চিত্র।
উৎসাহ দানে খামতি নেই। তবে তা গ্রহণে উৎসাহ কম কেন!
চাষিদের থেকে ধান কিনতে চেষ্টার অন্ত নেই সরকারের। তবু চাষিদের একটা বড় অংশ নিরুৎসাহী। ফড়ে মাজনা পোকা (ধানের ক্ষতিকর পোকা) জেনেও কেন তাদের কাছেই ছুটে যায় তারা? কৃষিক্ষেত্রে যুক্ত অনেকের মতে, এর পিছনে অন্য হাজার কারণ আছে। তবে মূল কারণ পরিকাঠামো। আরও সহজ করে বললে, সরকারি ধান ক্রয়কেন্দ্রের অপ্রতুলতা আর ফসল উৎপাদনস্থল থেকে সরকারি ক্রয়কেন্দ্রের দূরত্ব।
পরিসংখ্যান একটা ধারনা তৈরি করে। ঘাটাল ব্লকে মোট কৃষকের সংখ্যা ষাট হাজার। মোট চাষযোগ্য পরিমাণ হাজার ১৪ হাজার হেক্টর। এ বার ঘাটাল ব্লকে আমন ধান চাষ হয়েছিল ১২ হাজার পাঁচশো হেক্টর জমিতে। গড়পড়তায় মরসুমে পঞ্চাশ হাজার মেট্রিক টন ধান উৎপাদন হওয়ার কথা। এটি পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার একটি ব্লকের তথ্য। বাকি ২০টি ব্লকেও কৃষক এবং চাষযোগ্য জমির পরিমাণ কমবেশি একই। ঘাটাল ব্লকে ১২টি গ্রাম পঞ্চায়েত। তার মধ্যে বলরামগড়ে একটি ধান ক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। তা ছাড়া একটি সমবায় গোটা ব্লকে ধান কেনার সঙ্গে যুক্ত। তারসঙ্গে রয়েছে দুটি স্বনির্ভর গোষ্ঠী। তারাও ধান কেনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। বাদ বাকি আর কোনও মাধ্যম নেই।
সরকারি ধান বিক্রয় কেন্দ্রে ধান বিক্রয় করার কথা আমজনতাকে জানাতে প্রশাসনের তরফে জোর প্রচার চলছে। চাষিদের সুবিধার জন্য একাধিক উপায়ে ধান ক্রয়ের ব্যবস্থার কথাও বলা হচ্ছে। ব্লক প্রশাসন থেকে মহকুমা স্তরের একাধিক সদর দফতরেও ঝুলছে পোস্টার। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষায় সরকারি দফতরে পোস্টার ঝোলে। চাষি চলে তার নিজের সুবিধা মতো। দাসপুরের কুলটিকরির বাসিন্দা মানবেন্দ্র রায়চৌধুরী এবং চন্দ্রকোনার খুড়শির সুবল জানারা বলছিলেন, “বাড়ি থেকে ১৪-১৫ কিলোমিটার দূরে সরকারি ক্রয়কেন্দ্র। হাতের নাগালে কোথায় কেন্দ্র। সেখানে যাওয়া মানে তো আবার সারাদিনের ঝামেলা। কাছাকাছি হলে আগ্রহ বাড়ত। সেটা তো হচ্ছে না।”
খাদ্য দফতর অবশ্য জানাচ্ছে, এমনিতে ব্লকে একটি করে ধান ক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। গ্রামে শিবির করে সমবায় এবং গোষ্ঠীগুলি ধান কিনছে। তার আগে প্রচারও করা হচ্ছে। একাধিক সরকারি মনোনীত সংস্থাও ধান কেনায় যুক্ত হয়েছে। এতে ধান বিক্রিতে চাষিদের কোনও সমস্যা হওয়ার কথা নয়। প্রয়োজনে সমবায় গুলির সংখ্যা আরও বাড়ানো হচ্ছে। সরকারি সংস্থাগুলি সমবায় সমিতি এবং গোষ্ঠীর মাধ্যমে ধান কিনছে। সবমিলিয়ে চাষিদের হয়রানি হওয়ার কথা নয়। ঘাটাল মহকুমা খাদ্য নিয়ামক নন্দদুলাল দাস বলছিলেন, “ঘাটালে বলরামগড়ে স্থায়ী ধান ক্রয়কেন্দ্র রয়েছে।তার সঙ্গে সমবায় এবং গোষ্ঠীর তরফ থেকে শিবির করে ধান কেনা চলছে। শিবিরে যেতে চাষিদের আগ্রহও বাড়ছে।”
যদিও ভুক্তভোগী চাষিরা অবশ্য বলছেন অন্য কথা। তাদের বক্তব্য, আগের তুলনায় কেন্দ্র বাড়ানো হলেও এখনও সংখ্যা অনেক কম। সব এলাকায় সব সমবায় ধান কিনছে না। কম ধান নেওয়ার জন্য অন্য কোনও সংস্থাও আসতে রাজি হবে না। তা ছাড়া সবক্ষেত্রে চাষিদের সব ধান নেওয়ার মতো পরিকাঠামো নেই। দীর্ঘ লাইন। গ্রামে শিবির করে গোষ্ঠী কোথায় ধান কিনছে তাদের টিকিও পাওয়া যায় না। সমবায়ের নামই জানা যায় না।
সরকারের তরফে অবশ্য চেষ্টার ত্রুটি নেই। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা খাদ্য আধিকারিক অরিন্দম সরকার বলেন, “জেলায় পর্যাপ্ত ধান ক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। তারসঙ্গে ভ্রাম্যমাণ ধান ক্রয়কেন্দ্র এলাকায় গিয়ে ধান কিনছে। সঙ্গে একাধিক সংস্থা রয়েছে। তারা সমবায়,স্বনির্ভর গোষ্ঠীদের দিয়ে ধান কিনছে।”
সরকারের দাবি একেবার সঠিক। বাস্তবে সমস্যা রয়েছে অন্য আরেক জায়গায়। চাষি যত ফসল উৎপাদন করে তার সবটা কিনতে পারে না সরকার। চাষি প্রতি কত ধান কেনা হবে তা নির্দিষ্ট। তা হলে বাকি ফসল চাষি বিক্রি করবে কোথায়! মহাজনরা তাই থেকে যায় যুগে যুগে। শুধু পাল্টে যায় নাম।
মাজনা পোকার সঙ্গে বাস করেই চাষ করে চলে চাষি।
→→(চলবে)