সে রাতে সবে খাওয়া শেষ করে ঘুমোতে গিয়েছিলেন সুধাংশুশেখর মাইতি। বাড়িতে চড়াও হয়ে স্ত্রী-পরিজনদের সামনেই গুলি করে তাঁকে খুন করেছিল মাওবাদীরা। রক্তে ভেসে গিয়েছিল নহরিয়া গ্রামের বাড়ির উঠোন। হামলাকারী দলে ছিল এলাকার অনেক পরিচিত মুখ। শোনা যায়, ‘শ্রেণিশত্রু’ সিপিএমের লোধাশুলি লোকাল কমিটির সদস্য সুধাংশুবাবুকে খতমের ষড়যন্ত্রে সামিল হয়েছিলেন জনগণের কমিটিতে নাম লেখানো যুবকেরা। পরিবর্তনের জমানায় সেই সব মাও-মুখেরা এখন জনদরদী শাসক দলের নেতা-কর্মী। সিপিএমের দাবি, তাঁরা পঞ্চায়েতের ভাগ বাঁটোয়ারাতেও আছেন, বিরোধীশূন্য এলাকায় মানুষকে ‘ভরসা’ও জোগান!
পুলিশ সূত্রের খবর, গোপীবল্লভপুর বিধানসভার অন্তর্গত ঝাড়গ্রাম ব্লকের লোধাশুলি গ্রাম পঞ্চায়েতের নহরিয়া গ্রামের লাগোয়া জঙ্গলের মাটিতে এখনও অনেক দেহ পোঁতা রয়েছে। ‘শ্রেণিশত্রু’দের ধরে এনে লোপাট করে দেওয়া হতো এখানেই। কয়েকটি কঙ্কাল উদ্ধার হলেও অনেকেরই হদিশ মেলেনি শেষ পর্যন্ত। ভোট এলে ফের অজানা আশঙ্কায় বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠে সুধাংশুবাবুর স্ত্রী ইন্দ্রাণী মাইতি বা তাঁরই মতো স্বজনহারাদের।
ছ’বছর আগের সেই রাত আর হানাদার মুখগুলোই যেন ভেসে ওঠে চারপাশে। বুক ফেটে যায়, কিন্তু মুখে কুলুপ। এ ভাবেই দিন কাটছে ইন্দ্রাণীদেবীদের। চোখের জল মুছে তিনি বলেন, “স্বামীর মৃত্যুর ভয়ঙ্কর স্মৃতি আর যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে আছি। ওই ঘটনার পরে ছেলেকে নিজের কাছে রাখার সাহস পাইনি।” সেই ইন্দ্রাণীদেবীর বাড়ির দেওয়ালেই জ্বলজ্বল করছে তৃণমূল প্রার্থী চূড়ামণি মাহাতোর প্রচার-লিখন। ২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনে বাম সরকারের দাপুটে আইনমন্ত্রী সিপিএমের রবিলাল মৈত্রকে ৩২ হাজার ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে দিয়েছিলেন চূড়ামণিবাবু।
গোপীবল্লভপুর বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে রয়েছে, সাঁকরাইল ব্লকের দশটি, ঝাড়গ্রাম ব্লকের ন’টি ও বেলিয়াবেড়া ব্লকের চারটি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকা। ২০১১-র বিধানসভা ভোটে তৃণমূল প্রার্থী চূড়ামণি মাহাতো ৫৬.৭০ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন। সিপিএমের রবিলাল মৈত্র ৩৬.৫৫শতাংশ এবং বিজেপি-র সঞ্জিত মাহাতো মাত্র ৩.৭৪ শতাংশ। ২০১৩-র পঞ্চায়েত ভোটে ২৩টি গ্রাম পঞ্চায়েতের ২২টি-ই দখল করে তৃণমূল। শুধু সাঁকরাইলের কুলটিকরি যায় সিপিএমের দখলে। ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে ঝাড়গ্রাম লোকসভা কেন্দ্রের গোপীবল্লভপুর বিধানসভা ভিত্তিক ফলে তৃণমূল প্রার্থী উমা সরেন পেয়েছিলেন ৯২,২৩৫ ভোট। সিপিএমের পুলিনবিহারী বাস্কে পান ৪৭,৮২৯ ভোট। বিজেপি-র বিকাশ মুদি পেয়েছিলেন ১৮,১৯৫ ভোট। আর মাত্র ৪,৬০৩টি ভোট পেয়েছিলেন কংগ্রেসের অনিতা হাঁসদা। প্রাপ্ত ভোট অঙ্কের নিরিখে এগিয়ে রয়েছে তৃণমূল।
তাই বিরোধীদের কার্যত দুরমুশ করে বিদায়ী বিধায়ক তথা তৃণমূল প্রার্থী চূড়ামণি মাহাতো বলেন, “যত অপপ্রচার করবেন। তত আমাদের ভোট বাড়বে। ভোটের ফল বেরনোর পরে কী করবেন?”
বাম-কংগ্রেস জোটের অভিযোগ, নহরিয়া, ইন্দ্রাবনি, জয়বাঁধি, দহতমূল, হরকির মতো সব গ্রামে এক সময়ে যাঁরা মাওবাদী-কমিটির লোকজন ছিলেন, তাঁরাই এখন শাসক দলের পাহারাদার, অনেকেই তৃণমূলের নেতা। তাই নির্ভয়ে কথা বলার সাহসটুকুও নেই এলাকাবাসীর। একটা সময় ছিল, যখন এলাকার প্রায় সব রাস্তায় লাশ পড়ত। আর এখন শাসকের রক্তচোখ দেখে ডরান আমজনতা। বোঝেন, বাইরের লোকজনের কাছে মুখ খুললে বিপদ অবধারিত।
হরকি গ্রামের রাস্তায় বসে গল্প করছিলেন কয়েকজন আদিবাসী মহিলা। কেমন আছেন? প্রশ্ন শুনেই এ দিক সে দিকে তাকিয়ে মুখ নিচু করে ফেললেন এক বৃদ্ধা। চাপা স্বরে জানালেন, “যাঁদের পাওয়ার কথা নয়, তাঁরা বার্ধক্য ভাতা পেল, আমি তো পেলাম না!” কথা বেশি দূর এগোয়নি। তার আগেই মোটরবাইকে ঝড় তুলে দাঁড়িয়ে পড়েন টুপি পরা এক যুবক। সাংবাদিক জেনেই শুরু হয় জরিপ। তারপর ফতোয়া, “মানুষ কেমন আছেন, সেই তথ্য জানতে হলে আমাদের সঙ্গে কথা বলুন। বিধায়কের কাছে জানুন। আপনারা তো সব উল্টো লিখবেন।” রক্তচক্ষু দেখে অগত্যা সরে যেতেই হল। মেঠো রাস্তায় দেখা হল ইন্দ্রাবনি গ্রামের বাসিন্দা এক প্রৌঢ়ের সঙ্গে। তাঁর আক্ষেপ, “পরিবর্তনের পরে আমাদের ভাগ্যে তো কিছুই জুটল না।” তাঁর স্ত্রী একশো দিনের প্রকল্পে মাত্র তিন দিন কাজ পেয়েছেন।
লোধাশুলির পঞ্চায়েত সদস্য দ্বিজপদ মান্না অবশ্য দাবি করলেন, “গ্রামের কাঁচা রাস্তা এখন পাকা করার কাজ চলছে। গ্রামে গ্রামে টাইম কলে পরিস্রুত পানীয় পাচ্ছেন বাসিন্দারা। মানুষজন শান্তিতে বসবাস করছেন। মাওবাদীদের ভয়টা আর নেই।” তিনিই জানালেন, মাওবাদীরা নতুন করে এলাকায় ঢোকার চেষ্টা করলে ‘পাহারাদার’ গ্রামবাসীরা ওদের রুখে দেবেন। বেলিয়াবেড়ার শিশুশিক্ষা কেন্দ্রে খুদেদের পড়াচ্ছিলেন এক শিক্ষিকা। তাঁর কথায়, “এক সময় রক্তের উপর দিয়ে কাজে আসতাম। এখন পরিস্থিতি শান্ত। তবে যন্ত্রণার উপশম হয়নি। সিপিএমের শেষের দিকে যে পচন দেখেছি। সেটাই তো বর্তমান শাসকের একাংশের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি।” বেশি কথা বলতে হয়নি। প্রধান শিক্ষিকার ইশারায় চুপ করে যান তিনি। তারপর করজোড়ে বলেন, “আমরা খুব ভাল আছি।”
রাজ্যে ক্ষমতার পালা বদলের পরে সাঁকরাইল ব্লকের কুলটিকরির দোর্দণ্ডপ্রতাপ সিপিএম নেতা বাদল রাণাকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে গলায় জুতোর মালা পরিয়ে এলাকাছাড়া করা হয়েছিল। পরে বাদলবাবু বাড়ি ফিরলে তাঁর বিরুদ্ধে তৃণমূল সমর্থক এক মহিলা ধর্ষণের মামলা দায়ের করেছিলেন। গ্রেফতার হন বাদলবাবু। কিন্তু বিচার চলাকালীন অভিযোগকারী বিরূপ সাক্ষ্য দেওয়ায় বেকসুর খালাস পান বাদলবাবু। শাসক তৃণমূলের বিরুদ্ধে বিরোধীদের জব্দ করার এমন নানা উদাহরণ দিয়ে পথে নেমেছেন বাম-কংগ্রেস জোটের সিপিএম প্রার্থী পুলিনবিহারী বাস্কে। পুলিনবাবুর দেওয়াল লিখনে গোবর লেপে দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ। ছিঁড়ে দেওয়া হচ্ছে পোস্টার-ফেস্টুনও। বিজেপি প্রার্থী সুশীলকুমার ঘোষের প্রচার মিছিলেও হামলা চালানোর অভিযোগ উঠেছে শাসকদলের বিরুদ্ধে।
হেলদোল নেই শাসকের।