এগরার খাদিকুল গ্রামে বাজি তৈরির কারখানায় আগুন নেভাচ্ছেন দমকল কর্মীরা। নিজস্ব চিত্র
পাঁশকুড়ার সাধুয়াপোতার পর এ বার এগরার সাহাড়া। পরের পর বেআইনি বাজি বিস্ফোরণে মৃত্যু মিছিল অব্যাহত পূর্ব মেদিনীপুরে। এক বছরের মধ্যেই এই জেলায় তিন-তিনটি বড়সড় বিস্ফোরণে প্রাণহানি ঘটল।
মঙ্গলবার সকালে এগরার খাদিকুল গ্রামে বেআইনি বাজি কারখানায় জোরালো বিস্ফোরণে অনেকের মৃত্যুর খবর মিলেছে। জখমও বেশ কয়েকজন। পঞ্চায়েত ভোটের প্রাক্কালে একের পর এক বিস্ফোরণ ও হতাহতের ঘটনা একদিকে রাজনৈতিক চাপানউতোর চলছে, অন্য দিকে আতঙ্কিত আমজনতা। প্রশ্নের মুখে পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকাও।
এ দিন এগরায় যার বেআইনি বাজি কারখানায় বিস্ফোরণ হয়েছে, সেই কৃষ্ণপদ ওরফে ভানু বাগ এলাকার সক্রিয় তৃণমূল কর্মী বলেই জানা যাচ্ছে। বেআইনি বাজি তৈরির জন্য তাঁকে আগেও একবার গ্রেফতার করা হয়েছিল। র্বতমানে তিনি জামিনে মুক্ত ছিলেন। তবে ধরপাকড়েও বেআইনি বাজি ব্যবসায় যে দাঁড়ি পড়েনি এ দিনের ঘটনাই তার প্রমাণ। রাজ্যের বিরোধী দলনেতা তথা নন্দীগ্রামের বিজেপি বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারী টুইট বার্তায় অভিযোগ করেছেন, এগরা থানার পুলিশের সঙ্গে আর্থিক লেনদেন করেই এই বেআইনি কারবার চালাতেন 'তোলা-মূল' কর্মী ভানু। মাসোহারা বাবদ ৫০ হাজার টাকাও পুলিশকে দিতেন বলে দাবি শুভেন্দুর। বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার ঘটনায় এনআইএ তদন্ত দাবি করেছেন।
যদিও রাজ্যের মন্ত্রী মানস ভুঁইয়া বলছেন, "যার বাড়িতে বাজি তৈরি হচ্ছিল তাকে পুলিশ আগেও গ্রেফতার করেছিল। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনত ব্যবস্থা নেওয়া এবং মৃতদের পরিবারকে সহযোগিতা করার জন্য জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় প্রশাসনকে রাজ্য সরকারের তরফে নির্দেশ পাঠানো হয়েছে।" প্রশাসনিক গাফিলাতির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন পূর্ব মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার অমরনাথ কে-ও। তিনি বলছেন, "অবৈধ বাজির বিরুদ্ধে ধরপাকড় চলে। এ দিন যাঁর বাড়িতে বিস্ফোরণ ঘটেছে তাঁকে আগেও পুলিশ গ্রেফতার করেছে। জামিনে ছাড়া পাওয়ার পর আবার তিনি বেআইনিভাবে বাজি তৈরি করছিলেন।"
একটা সময় দীপাবলি ও কালীপুজো উপলক্ষে বাজির মরসুম চলত। তবে ইদানিং বিয়েবাড়ি থেকে শুরু করে গ্রামের শীতলা পুজো, মানতের কালীপুজোতেও বাজি ফাটানো হয় দেদার। কাঁথি শহরের সুপার মার্কেটের কয়েকজন বাজি বিক্রেতা জানাচ্ছেন, শুধুমাত্র বর্ষাকালে বাজি বিক্রি হয় না। বাকি সারা বছরই বিভিন্ন এলাকায় পারিবারিক এবং গ্রামীণ অনুষ্ঠানের জন্য বাজির বরাত আসে। সেই মতো বাজি তৈরিও হয়। এগরার খাদিকুলেও তেমনটাই হচ্ছিল বলে খবর।
নিয়ম মাফিক বাজি তৈরির কারখানার জন্য লাইসেন্স থাকা বাধ্যতামূলক।পরিবেশ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের অনুমতি পত্র, অগ্নি নির্বাপণ দফতরের ছাড়পত্র এবং স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েতের কাছ থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিতে হয়। কিন্তু, এই সব ছাড়াই বিভিন্ন এলাকায় রমরমিয়ে চলছে বাজির কারবার। ফলে বাজি ঘিরে বিপদ এখন সারা বছর জুড়েই। কলকাতা কিংবা প্রতিবেশী রাজ্য ওড়িশা থেকে চোরাপথে বাজি তৈরির নানা মশলা এই জেলায় আনা হচ্ছে বলে জানা গিয়েছে।
২০২২ সালের ২ ডিসেম্বর ভূপতিনগরে এক তৃণমূল কর্মী রবীন্দ্রনাথ মান্নার বাড়িতে বিস্ফোরণে তিনজনের মৃত্যু হয়। রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী থানায় লিখিত অভিযোগে জানিয়েছিলেন, তাঁর বাড়িতে অবৈধভাবে বাজি তৈরি করা হত। তার আগে পাঁশকুড়ার সাধুয়াপোতা গ্রামে বাজি কারখানায় বিস্ফোরণ ঘটে। কিন্তু বারবার বিস্ফোরণের পরেও কী ভাবে চলছে এইবেআইনি কারবার?
অভিযোগ, পুলিশ-প্রশাসনের একাংশের মদতেই বেআইনি বাজি কারখানাগুলো চলছে। পুলিশের নাকের ডগায় কারবার চললেও তাই কিছুই হচ্ছে না। পূর্ব মেদিনীপুর জেলা কংগ্রেসের সভাপতি মানস কর মহাপাত্র বলছেন, "পুলিশের নাকের ডগায় বারবার বিস্ফোরণ ঘটছে। কিন্তু পুলিশ কোনও পদক্ষেপ করছে না।" পুলিশ সুপার অবশ্য বলেন, "অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।"