খালের জলে ভাসছে ডলফিন (গোল চিহ্নিত)। পাড়ে প্রচুর মানুষের ভিড়। —নিজস্ব চিত্র
জলে গেল জলে ফেরানোর চেষ্টা!
দু’দিন ধরে এ-দিক ও-দিক ছুটে বেড়ানোর পরে খালের ঘোলা জলে ভেসে উঠল পথভোলা ডলফিনের মৃতদেহ। আর এই ঘটনায় আরও একবার বন দফতরের ভূমিকা নিয়ে যেমন প্রশ্ন উঠে গেল, তেমনই সামনে এল দফতরের হতশ্রী পরিকাঠামোও।
গত বৃহস্পতিবার বিকেলে বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী রসুলপুর নদী পেরিয়ে ওড়িশা কোস্ট ক্যানাল এবং কালীনগর-ইটাবেড়িয়া খাল হয়ে বিপন্ন প্রজাতির একটি ডলফিন ঢুকে পড়েছিল দাঁড়িয়াদিঘি-উদবাদাল খালে। উদবাদাল সেতুর কাছে বিশালাকৃতির ওই প্রাণীটিকে সাঁতার কাটতে দেখে এলাকায় খবর ছড়িয়ে পড়েছিল। তখন থেকে নাসিক খালে ডলফিন দেখার জন্য দলে দলে ভিড় জমাতে শুরু করে বিভিন্ন এলাকার লোকজন।
খবর পেয়ে বাজকুল থেকে বন দফতরের কর্মীরা সেখানে যান। শুক্রবার থেকে ওই খালে স্পিডবোটে করে কর্মীরা ডলফিনটিকে ‘তাড়া’ করে কালিনগর হয়ে বঙ্গোপসাগরের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু শান্ত এবং ভিতু ওই সামুদ্রিক প্রাণী স্পিডবোটের আওয়াজ আর খালের দুই পাড়ে লোকের ভিড় দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে বলে বন দফতরেরই এক সূত্রে খবর। ডলফিনটি সমুদ্রের দিকে না গিয়ে বিপরীতে ইটাবেড়িয়ার দিকে এগোতে থাকে। সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় শুক্রবারের মতো অভিযান বন্ধ করে দেন বনকর্মীরা।
শনিবার সকালে ইটাবেড়িয়া থেকে সামান্য আগে নেতুড়িয়ায় ভাসতে দেখা যায় ডলফিনের দেহ। সেই দেহ ডাঙায় তুলে শুরু হয় তার সঙ্গে ছবি তোলার হিড়িক। ঠিক যেমনটা হয়েছিল পশ্চিম মেদিনীপুরের চাঁদড়ার বাঘঘোরার জঙ্গলে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারকে মারার পরে। ডলফিনের মৃত্যুতেও বন দফতরের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ডলফিনকে সুস্থ অবস্থায় সমুদ্রে ফিরিয়ে দেওয়ার পদ্ধতি সম্পর্কে কি আদৌ কিছু জানতেন কর্মীরা? মৎস্য দফতরের সঙ্গে কি আলোচনা করেছিলেন? দফতরের পরিকাঠামোই বা কী রয়েছে?
মৎস্য দফতরের আধিকারিকেরা জানাচ্ছেন, মৃত প্রাণীটি ‘গ্যাঞ্জেটিক ডলফিন’। এরা মূলত সমুদ্রের একেবারে স্বচ্ছ জলে এবং মনোরম আবহাওয়ায় বাস করে। সে ক্ষেত্রে উদবাদাল খালের সংকীর্ণতা, দূষিত জল এবং জনবহুল এলাকা একেবারেই যন্ত্রণাদায়ক হয়ে গিয়েছিল ডলফিনের কাছে। তাছাড়া, গত দু’দিন ধরে সে পর্যাপ্ত খাবারও পাচ্ছিল না। তার উপর শুক্রবার বন কর্মীদের তাড়া খেয়ে প্রাণীটি আরও বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। সব মিলিয়েই তার মৃত্যু হয়েছে বলে মৎস্য দফতরের বিশেষজ্ঞদের মত। মৃত প্রাণীটির দেহে একাধিক আঘাতের চিহ্নও রয়েছে। তাতে মনে করা হচ্ছে, তাড়ার সময় খালের একাধিক কাঠের সেতুতে ডলফিনটি ধাক্কা খেয়েছে। স্থানীয় মৎস্যজীবীদের ছোট ফাঁসের জালেও হয়তো তার শরীর জড়িয়ে গিয়েছিল।
প্রশাসন সূত্রের খবর, বৃহস্পতিবার বিকেলে মৎস্য দফতরের সহযোগিতা চেয়ে ছিল পুলিশ। কিন্তু তারা সরাসরি এ ব্যাপারে বন্যপ্রাণী সুরক্ষা বিধি মেনে ডলফিনকে ফের সমুদ্রে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বন দফতরের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দিয়েছিল। প্রয়োজনে বনদফতরের ডিভিশন আধিকারিকের সঙ্গে কথা বলে এ ধরনের বিপন্নপ্রায় প্রাণীকে তার স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিশেষজ্ঞ আনানোর সুপারিশ করা হয়েছিল। এমনকী, গত শুক্রবার কোলাঘাটে বুলবুল ঘূর্ণিঝড় নিয়ে পরিবহণমন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারীর উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকেও ডলফিন প্রসঙ্গ উঠেছিল। তখনও সতর্কভাবেই পা ফেলার পরামর্শ দিয়েছিল মৎস্য দফতর।
কিন্তু তার পরেও মারা গেল ডলফিনটি। এই ধরনের প্রাণীকে সমুদ্রে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পদ্ধতি কী? এ ব্যাপারে মৎস্য দফতর জানিয়েছে, খালের দু’পাশে জাল দিতে হত। ডলফিনকে পিছন থেকে যেমন ধীর ধীরে ‘তাড়া’ করতে হবে, তেমনই তাকে খাবারের টোপ দিয়েও সামনে ডাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে কী সে সব করা হয়েছিল? নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কাঁথি মহকুমা এক রেঞ্জের আধিকারিক বলেন, ‘‘মূলত বনের রক্ষণাবেক্ষণ যারা করেন, তাঁরাই শুক্রবার ডলফিন উদ্ধারে গিয়েছিলেন। ওঁরা কী ভাবে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিধি মেনে ডলফিনকে তার স্বাভাবিক পরিবেশে ফিরিয়ে যাবেন! ওই পদ্ধতিই তো জানেন না ওঁরা।’’
ওই আধিকারিকের অভিযোগ, নামমাত্র একটা প্রশিক্ষণ দিয়ে বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী উপকূলবর্তী এলাকায় বন দফতর কাজ চালাচ্ছে। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার বন আধিকারিক স্বাগতা দাস বলেন, ‘‘ডলফিন উদ্ধারের মতো পরিকাঠামো আমাদের ছিল না। সেটিকে সমুদ্রে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাড়া করা হচ্ছিল। সেই চেষ্টা শুক্রবার ব্যর্থ হয়েছে। শনিবার ফের চেষ্টা করা হত। কিন্তু তার আগেই ডলফিনটি খালের দূষিত জল এবং খাবারের সঙ্কটে মারা গিয়েছে। আমাদের অভিযানে পদ্ধতি নিয়ে কোনও ভুল ছিল না।’’
উল্লেখ্য, ৭৮ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে রয়েছে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার উপকূলবর্তী এলাকা। গত এক বছর ধরে প্রায়ই মৎস্যজীবীদের জালে বেশ কয়েকটি শুশুক মৃত অবস্থায় ধরা পড়েছে। এছাড়া, জেলায় হামেশাই বন বিড়াল, কচ্ছপের মত বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী উদ্ধার হয়। তাই কেন উপকূলবর্তী এলাকায় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের উপযুক্ত কর্মী এবং পরিকাঠামো রাখেনি বন দফতর, সেই প্রশ্নের সদুত্তর মেলেনি।
ডলফিনের মৃত্যুতে সহ-মৎস্য অধিকর্তা (সামুদ্রিক) সুরজিৎ বাগের আক্ষেপ, ‘‘এ ধরনের ডলফিন অত্যন্ত স্পর্শকাতর। সকলকে সতর্ক করে দিয়েছিলাম। কিন্তু বিশেষজ্ঞ না রেখে এভাবে ডলফিনকে সমুদ্রের নিয়ে যাওয়ার পদ্ধতি কতটা ঠিক, সেটা দেখতে হবে। আগামীতে বন দফতরকে আরও সজাগ থাকতে হবে।’’