মানচিত্র স্ক্যানেও ঢিলেমি

পশ্চিমে ২৫ মৌজায় নেই জমির খতিয়ান

জলাজমিটি বুজিয়ে বাস্তুভিটে হয়েছে অনেকদিন। কোথাও আবার চাষের জমিটি রাস্তা হয়ে গিয়েছে। আবার অনাবাদি জমি পরিণত হয়েছে কৃষি জমিতে, কোথাও বা তৈরি হয়েছে পুকুর-বাঁধ। তবে সরকারি হিসাবে তার কোনও পরিবর্তন নেই। ভূমি সংস্কার আইন তৈরি হয়েছিল ৬০ বছর আগে। কিন্তু জমির খতিয়ান হিসাবের খাতায় রয়ে গিয়েছে সেই ১৯৫৫ সালের মতোই।

Advertisement

সুমন দে

মেদিনীপুর শেষ আপডেট: ১১ জুন ২০১৫ ০০:৪৮
Share:

জলাজমিটি বুজিয়ে বাস্তুভিটে হয়েছে অনেকদিন। কোথাও আবার চাষের জমিটি রাস্তা হয়ে গিয়েছে। আবার অনাবাদি জমি পরিণত হয়েছে কৃষি জমিতে, কোথাও বা তৈরি হয়েছে পুকুর-বাঁধ।

Advertisement

তবে সরকারি হিসাবে তার কোনও পরিবর্তন নেই। ভূমি সংস্কার আইন তৈরি হয়েছিল ৬০ বছর আগে। কিন্তু জমির খতিয়ান হিসাবের খাতায় রয়ে গিয়েছে সেই ১৯৫৫ সালের মতোই।

রাজ্যের অনেক জেলাতেই এই অবস্থা। খতিয়ান তৈরির কাজ শুরুই করা যায়নি কোথাও কোথাও। পশ্চিম মেদিনীপুরে ২৫টি মৌজার খতিয়ান এখনও তৈরি হয়নি। এ দিকে কেন্দ্রীয় সরকার জমি জট কাটাতে ‘ন্যাশনাল ল্যান্ড রেকর্ডস মর্ডানাইজেশন প্রোগ্রাম’ হাতে নিয়েছে। যে প্রকল্পে উপগ্রহ চিত্রের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এলাকারও স্পষ্ট ছবি দেখা যাবে। সে প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাড়িতে বসে কম্পিউটারে ক্লিক করলেই নিজের বাড়ি, জমি দেখতে পাবেন সকলে।

Advertisement

কিন্তু সে তো অনেক দূরের কথা। ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরে যে খতিয়ান থাকার কথা, তা-ই পাওয়া যায় না সুনির্দিষ্ট ভাবে। বহু মৌজার ক্ষেত্রে ভরসা এখনও সেই পুরনো সিএস বা আরএস খতিয়ান। ফলে জমির নামপত্তন বা চরিত্র পরিবর্তন করাতে গিয়ে চূড়ান্ত অসুবিধায় পড়েন সাধারণ মানুষ। আবার যে সব জায়গার খতিয়ান রয়েছে, সেখানে রয়েছে অন্য সমস্যা।

দফতর সূত্রের খবর, বেশ কয়েক হাজার নথির কাগজ পাঁপড়ের মতো হয়ে গিয়েছিল। যা ভেঙেচুরে একাকার হয়ে গিয়েছে। তা থেকে পাঠোদ্ধার অসম্ভব। ফলে সেগুলি নতুন করে তৈরি করতে হবে। অথচ এই সব নথি স্ক্যান করে ডিজিটাইজ করার উদ্যোগ নিয়েছিল রাজ্য সরকার। অন্যান্য জেলার সঙ্গেই পশ্চিম মেদিনীপুরেও গত আর্থিক বছরে সে কাজ শুরুও হয়েছিল। কিন্তু এগোয়নি বেশিদূর।

পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা ভূমি ও ভূমি সংস্কার আধিকারিক অরিন্দম দত্ত অবশ্য বলেন, “যে সব মৌজার খতিয়ান তৈরি হয়নি তাদের আপডেট করার কাজ শুরু হয়েছে। ২৫ মৌজার মধ্যে ৩ মৌজার কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে। বাকি মৌজারও কাজ চলছে দ্রুত গতিতে। নথি ডিজিটাইজ করার ক্ষেত্রেও কাজ শেষ করার চেষ্টা চলছে।”

প্রশাসন সূত্রেই জানা গেল, মেদিনীপুর শহরের বারপাথর ক্যান্টনমেন্ট, চাঁদিয়ানা বাজার, কলোনেলগোলা, শেখপুরা, কেরানীতলা, গড়বেতা-১ ব্লকের গনগনি, কেশপুর ব্লকের আনন্দপুর, শাবড়া, গোপীনাথপুর ও খড়্গপুর-১ ব্লকের বড়কোলা, সোনামুখী, খাসজঙ্গল, দেবলপুর, ইন্দা, রূপনারায়ণপুর, মালঞ্চ, অন্ধ্রকুলি, তালবাগিচা, তেলিঘানা, নিমগেড়িয়া পাটনা, সাঁজোয়াল, কৌশল্যা, তেউতিচটি, গাইকাটা প্রভৃতি মৌজাগুলির খতিয়ান এখনও নতুন করে তৈরি করা যায়নি। ফলে বেজায় সমস্যায় সাধারণ মানুষ।

জমি হাত বদল হলেই পুরনো দিনের খতিয়ান খুঁজে বেড়াতে হয়। যে খতিয়ান থেকে প্রকৃত চিত্রও পাওয়া কঠিন। তখন একমাত্র উপায় পরিদর্শনের। ভূমি সংস্কার দফতরের আধিকারিকদের দিয়েই পরিদর্শন করাতে হয়। আর সে ক্ষেত্রেই এসে পড়ে অসদুপায়ের প্রশ্ন। অনেকেই অভিযোগ করেন সামান্য কাজটুকু করে দিতে একাংশের আধিকারিক নানা টালবাহান করেন। এমনকী ঘুষ নেওয়ার অভিযোগও তোলেন কেউ কেউ।

তবে হাল খতিয়ান না থাকলেও রাজস্বের ক্ষেত্রে খুব একটা সমস্যা হয় না বলে দাবি ভূমি সংস্কার দফতরের। অরিন্দম দত্তের কথায়, “সাধারণত শিবির করে খাজনা আদায় করা হয়। তাই স্থানীয় সূত্রে জমির পরিবর্তনের কথা জানা যায়। সেই মোতাবেক খাজনা নেওয়া হয়। ফলে খাজনাতে ফাঁকি দেওয়ার সম্ভাবনা কম।’’

কিন্তু পুরনো খতিয়ান খুঁজে পাওয়াও কঠিন কাজ। খুঁজে পাওয়া গেলেও হয়তো দেখা যায়, প্রয়োজনীয় জায়গাটি অস্পষ্ট হয়ে, কিংবা দীর্ঘদিনের পুরনো কাগজ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ফলে নামপত্তন বা জমির চরিত্র পরিবর্তন করাতে জেরবার হতে হয় সাধারণ মানুষকে। নামপত্তনের সময় চূড়ান্ত দুর্ভোগে পড়তে হয় আবেদনকারীকে।

ভূমি সংস্কার আইন চালুর পর যে সব নতুন নথি তৈরি হয়েছিল তার বেশিরভাগই অবশ্য স্ক্যান করা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু রেভিনিউ অব সেটেলমেন্ট (আরএস)-এর বেশিরভাগ নথিই থেকে গিয়েছে আগের মতো। দ্রুত এই কাজ না করা গেলে ভবিষ্যতে আরও রেকর্ড নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

দফতরের কর্মীরাই বলছেন, এলআরের নথি স্ক্যান করার ক্ষেত্রে অগ্রগতি ভাল হলেও আরএসের ক্ষেত্রে অগ্রগতি কম। এখন পর্যন্ত প্রায় ১৮ লক্ষ ৪৪ হাজার এলআর রেকর্ড স্ক্যান হয়েছে। আরএস রেকর্ড স্ক্যান হয়েছে মাত্র সাড়ে ৬ লক্ষের মতো। এমন কত রেকর্ড রয়েছে? ভূমি সংস্কার দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, কাজ সম্পূর্ণ না হলে সঠিক পরিসংখ্যান মেলা কঠিন। তবে আনুমানিক এলআর-এর ক্ষেত্রে রেকর্ডের সংখ্যা ২২ লক্ষ ছাড়িয়ে যাবে। আরএস কিছুটা কম।

মেদিনীপুর শহরের কেরানিতলার বাসিন্দা বন্দনা মাইতির কথায়, ‘‘আমার নাম পত্তন করতে তিন বছর ঘুরতে হয়েছে। হাল খতিয়ান না-থাকায় এই সমস্যা।’’ এ দিকে খতিয়ান তৈরি হচ্ছে মালঞ্চ এলাকার। সেখানকার বাসিন্দা রজেশ শর্মার অভিজ্ঞতা, “আমাদের তো নামপত্তনের আবেদনই নিচ্ছে না। বলছে, খতিয়ান তৈরির কাজ চলছে। কিছুদিনের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। তারপর আবেদন করতে বলছে।’’

অথচ নতুন খতিয়ান থাকলে অফিসে বসে অল্প সময়ে কাজটি সহজেই করা যেত। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার মৌজা সংখ্যা ৮৮২০টি। জেলার ২৯টি ব্লক। প্রতিটি ব্লক মাসে ১টি করে মৌজার কাজ করলেও ২৫ বছরে তা শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। তা হয়নি। কবে হবে সে প্রশ্ন করাও বাতুলতা।

এ দিকে নথি ডিজিটাইজ করার ক্ষেত্রে কাজ যেমন এগোয়নি, তেমনই পুরনো নথি নতুন করে তৈরি করার প্রয়োজন পড়ছে। সে সংখ্যাটাও নেহাৎ কম নয়। দফতরের কর্মীরাই জানাচ্ছেন প্রায় হাজার দশেক নথি নতুন করে তৈরি করতে হবে।

কী ভাবে তা হবে? ভূমি দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, জেলার কোনও দফতরে যদি তার কোনও পুরনো নথি থাকে তা দেখে তৈরি করা যাবে। অথবা যে সালের ঘটনা সেই সালের নথি খুঁজে বের করতে হবে। তারপর জমি পরিদর্শন করে নতুন নথি তৈরি করতে হবে।

এতএব, বিষয়টি অত্যন্ত জটিল। এ সব জেনেও এত ঢিলেমি!

প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, রাজ্য সরকার এই কাজের দায়িত্ব দিয়েছে যাদের, সেই এজেন্সির গড়িমসিতেই এত দেরি। ওই এজেন্সি ঠিক করে দেওয়া হয়েছে ডাইরেক্টর অব ল্যাণ্ড রিফর্মস থেকে। ঢিলেমির বিষয়টি তাঁদের জানানোও হয়েছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement