বসন্ত দাস। —ফাইল চিত্র ।
পরনে খদ্দরের জামা আর ধুতি। জমির আলপথ বেয়ে চোঙা হেঁকে ভোট চাইছেন এক প্রৌঢ়। ভোটপ্রার্থী তিনি নিজে। প্রতিপক্ষ তাঁর শিক্ষক।
১৯৫২ সাল। স্বাধীন ভারতে প্রথম লোকসভা নির্বাচন। ঐতিহাসিক সেই ভোটে সবাইকে চমকে দিয়ে জিতেছিলেন কংগ্রেস প্রার্থী পূর্ব মেদিনীপুরের খেজুরির বসন্ত দাস। হারিয়েছিলেন নিজেরই শিক্ষক প্রমথনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে।
তারও আগে ইতিহাস গড়ে দেশের সংবিধান রচনা কমিটিতে ঠাঁই করে নিয়েছিলেন বসন্ত। খসড়া সংবিধান তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল তাঁর। গণপরিষদের সদস্য হন। পরে কাঁথি থেকে দু’বারের (১৯৫২-১৯৫৭ এবং ১৯৬২-১৯৬৭ সাল পর্যন্ত) সাংসদ। প্রয়াত সেই রাজনীতিবিদের স্মৃতি পড়ে অনাদরে। আরও একটি প্রজাতন্ত্র দিবস এসে গেল। অথচ, সংবিধান রচয়িতাদের অন্যতম, বসন্তের স্মৃতি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেই।
১৮৯৮ সালের ১ মার্চ খেজুরি-২ ব্লকের রামচক গ্রামে জন্ম বসন্তের। তাঁর পুরনো বসতবাড়ি বছর দু’য়েক আগে ভেঙে পড়েছে। সেই জমিতে টোম্যাটো চাষ করেছেন বসন্তের প্রপৌত্র নিবেদন দাস। পাশে এক ফালি জমিতে আবাস যোজনার টাকায় ছোট্ট বাড়ি নিবেদনের। পাকা দেওয়াল, তবে উপরে অ্যাসবেস্টসের ছাউনি। অর্থকষ্ট নিত্যসঙ্গী। পেশায় রাজমিস্ত্রির জোগাড়ে নিবেদন বলছেন, ‘‘কোনও মতো বেঁচে আছি।’’
সাংসদ থাকাকালীন দিল্লিতে অধিবেশন শেষ হলেই ফিরে আসতেন বসন্ত। কাঁথি শহরে একটি ট্রাস্টের বাড়িতে থাকতেন তখন। সাধারণের অবাধ যাতায়াত ছিল সেখানে। ১৯৬২ সালের নির্বাচনের সময় বসন্তের হয়ে প্রচার করেছিলেন কাঁথির প্রবীণ কংগ্রেসী শৈলজা দাস। তিনি বলেন, ‘‘মানুষের অভাব-অভিযোগ মন দিয়ে শুনতেন বসন্তবাবু। যেটা পারতেন, করে দিতেন। অপারগ হলে না-টাও বলতেন হাসি মুখে।’’ কাঁথি পলিটেকনিক কলেজের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদন এবং মহকুমা হাসপাতালে ভবন তৈরির পিছনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বসন্তের।
বসন্তের স্ত্রী তরঙ্গিনীও ছিলেন খেজুরির নারী আন্দোলনের নেত্রী। ১৯৮৪ সালের ১ ডিসেম্বর প্রয়াত হন বসন্ত। ১৯৬৭ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত ‘বাংলা কংগ্রেস’-এর বিধায়ক হয়েছিলেন বসন্তর বড় ছেলে পরেশকান্তি দাস। তিনি মারা গিয়েছেন। নাতি সজলকান্তি দাসেরও মৃত্যু হয়েছে কয়েক বছর আগে। সজলেরই ছেলে নিবেদন।
বসন্তর সাধারণ জীবনযাপন আর মানুষের পাশে থাকার ব্রতকে আজও শ্রদ্ধায় স্মরণ করেন জেলার বহু প্রবীণ। রাজনীতির আঁধারে ব্যতিক্রমী আদর্শ হিসাবে তাঁর উদাহরণ টানা হয়। অথচ, এলাকাবাসীর ক্ষোভ, সেই মানুষটির স্মৃতিরক্ষার প্রচেষ্টা হয়নি। দাস পরিবারের প্রতিবেশী অর্ণব মণ্ডলের আক্ষেপ, ‘‘অত বড় মাপের এক জন মানুষ যেখানে থাকতেন, সেটা সংরক্ষণে সরকার কিছুই করেনি। নতুন প্রজন্ম এঁদের কথা জানবে কী করে!’’ খেজুরির ঐতিহ্য সুরক্ষা সমিতির সহ-সম্পাদক সুমননারায়ণ বাখরা জানালেন, ওই বাড়িতে এখনও বহু দুষ্প্রাপ্য বই, ছবি ও নানা নথি রয়েছে। বহু স্বাধীনতা সংগ্রামীর পদধূলি পড়েছে এই বাড়িতে। শৈলজারও মত, ‘‘শ্রদ্ধেয় এই রাজনীতিবিদের খেজুরির বাড়ি সংরক্ষণের দাবি সঙ্গত।’’
খেজুরি ২-এর বিডিও উদয়শঙ্কর মাইতি বলেন, ‘‘ওঁর বসতভিটে সংরক্ষণে প্রস্তাব পাইনি। খোঁজ নিয়ে, পরিবারের পাশে থাকার চেষ্টা করব।’’