সকাল থেকেই ভিড় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে।
চিত্র এক: খড়্গপুর শহরের বোগদা উপ-ডাকঘর। দেওয়ালে সাঁটানো রয়েছে— ১০ নভেম্বর থেকে পুরনো পাঁচশো ও হাজার টাকার নোট ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত বদল করে দেওয়া হবে। কিন্তু লাইনে এক ঘণ্টা দাঁড়ানোর পরে রেলকর্মী এমবি রাওকে শুনতে হল, “টাকা বদল হবে না।”কেন জানতে চাওয়ায় ঝাঁঝিয়ে উঠলেন কাউন্টারের কর্মী, “অত কথার জবাব দিতে পারব না।’’
চিত্র দুই: সাত সকালেই দু’টো এক হাজার ও চারটি পাঁচশো টাকার নোট নিয়ে বেরিয়েছিলেন বৃদ্ধ অমিতাভ পাল। স্টেট ব্যাঙ্কের মেদিনীপুর শাখার সামনে লম্বা লাইন দেখে তিনি যান পঞ্চুরচকে অন্য এক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের শাখায়। সকাল ৯টা থেকে অপেক্ষার পরে শেষে দুপুর ১২টা নাগাদ ৪ হাজারের ১০০ টাকার নোটের বান্ডিল নিয়ে বাড়ি ফিরলেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘বৃদ্ধ বয়সে লাইনে দাঁড়িয়ে তো টাকা পরিবর্তন সম্ভব নয়। তাই দেরি হলেও উপায় কী। তবে এখানে বসার সুযোগটুকু পেয়েছি।’’
চিত্র তিন: খড়্গপুরে স্টেট ব্যাঙ্কের মালঞ্চ শাখা। স্থানীয় বাসিন্দা বেসরকারি সংস্থা থেকে অবসর নেওয়া তরুণ ভট্টাচার্য এসেছিলেন টাকা তুলতে। কিন্তু দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পরে এক পুলিশকর্মী বললেন, টাকা তোলা বন্ধ রয়েছে। ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের কাছে গিয়েও লাভ হল না। ক্ষুব্ধ তরুণবাবু বললেন, “হাতে টাকা নেই। এটিএম বন্ধ। এখানে টাকা তোলা গেল না। জানি না কী হবে!’’
লাইনে দাঁড়িয়েও পাওয়া গেল না টাকা।
পাঁচশো ও হাজার টাকার নোট বদল শুরু হতেই ভোগান্তির এমনই সব ছবি সামনে এল মেদিনীপুর ও খড়্গপুর শহরে। নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলতে পারলেন না অনেকে। ব্যাঙ্ক ও ডাকঘর কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আছড়ে পড়ল ক্ষোভ। বারবার নিয়ম বদলানোয় বিভ্রান্ত হন ব্যাঙ্ক ও ডাকঘরের সামনে মোতায়েন পুলিশকর্মীরাও। মালঞ্চর স্টেট ব্যাঙ্কে লাইন নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা এক পুলিশকর্মীর কথায়, “ব্যাঙ্ক থেকে এক এক সময় এক এক রকম নিয়ম বলছে। আমরাও বুঝতে পারছি না কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল।’’ ওই ব্যাঙ্কে টাকা বদলানোর লাইনে দাঁড়ানো জিতেন্দ্র মহাপাত্র, পরমজিৎ সিংহরা আবার বলছিলেন, “আধঘন্টা হল দাঁড়িয়ে আছি। লাইন তো নড়ছেই না।’’ যদিও স্টেট ব্যাঙ্কের খড়্গপুরের দায়িত্বে থাকা রিজিওনাল ম্যানেজার মনমোহন রথের দাবি, “আমি সব শাখায় ঘুরেছি। কাজ সুষ্ঠু ভাবেই হচ্ছে। তবে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক রয়েছে। তাই ভিড় হচ্ছে। আশা করছি একদিন পরেই সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে।”
সব ব্যাঙ্কেই এ দিন লাইন ছিল। মহিলা ও বয়স্কদের জন্য আলাদা লাইনের ব্যবস্থা না থাকায় ভোগান্তি বেড়েছে। গোলবাজারের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে বেরোনো সঙ্গীতা সাহা বলেন, “আমাকে দেড় ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে পুরনো নোট জমা দিতে হল।”দুর্ভোগে পড়েছেন বোগদা উপ-ডাকঘরের গ্রাহকরাও। অনেকে টাকা বদলাতে পারেননি। কর্মীরা দুর্ব্যবহার করেছেন বলেও অভিযোগ। পোস্টমাস্টার অরুণ নন্দী অফিসে ছিলেন না। ফোনে তিনি বলেন, “আমি ছুটিতে রয়েছি। দায়িত্বে রয়েছেন আরতি সাঁতরা।’’ এক মহিলা নিজেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত পোস্টমাস্টার পরিচয় দিয়ে বললেন, “টাকা নেই। তাই নোট বদলে দিতে পারছি না।’’
মেদিনীপুরে আবার বেশিরভাগ গ্রাহকই নিয়ম কানুন নিখুঁত না জানায় সমস্যা বাড়ে। স্ত্রীর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা জমা দিতে এসে স্বামী এর জন্য স্ত্রীর লিখিত অনুমতিপত্র লাগবে। ফের বাড়ি ফিরে স্ত্রীর অনুমতিপত্র নিয়ে নতুন করে লাইনে দাঁড়ালেন তিনি। সমস্যায় পড়তে হচ্ছে সরকারি অফিসগুলিকেও। চালান লিখে টাকা নিয়ে ব্যাঙ্কে হাজির রেজিস্ট্রেশন দফতরের কর্মী, রেলের ভেন্ডার। সঙ্গে পাঁচশো-হাজার টাকার নোট। যদিও ব্যাঙ্ক জানিয়ে দিয়েছে, ব্যক্তিগত ছাড়া সরকারি টাকা নেওয়া যাবে না।
পিপলস্ কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কে তো আবার মাঝপথেই টাকা শেষ। সেখানে গ্রাহকেরা বিক্ষোভও দেখান। তবে ভিড় সামলাতে পুলিশ মোতায়েন ছিল। পিপলস্ কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কের সিইও মদনমোহন ঘোষ ও ডিরেক্টর তাপস সরকার বলেন, ‘‘মাঝে টাকা শেষ হয়ে যাওয়ায় গ্রাহকদের একটু অসুবিধেয় পড়তে হয়েছিল। পরে টাকা এনে অবস্থা সামাল দেওয়া হয়েছে।’’
-সৌমেশ্বর মণ্ডল ও রামপ্রসাদ সাউ।