মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ। —ফাইল চিত্র।
চিকিৎসক সংগঠনগুলির সঙ্গে মুখ্যসচিব মনোজ পন্থের বৈঠক ফলপ্রসূ হল না। বৈঠক থেকে বেরিয়ে হতাশা প্রকাশ করলেন সিনিয়র ডাক্তারেরা। তবে বৈঠকে সব কিছু নেতিবাচক হয়েছে, এমনটা মানতে নারাজ মুখ্যসচিব। তিনি জানান, জুনিয়র ডাক্তারদের ১০টি দাবির মধ্যে সাতটির বিষয়ে অগ্রগতি হয়েছে। তবে বাকি তিনটি দাবি কবে পূরণ হবে, সেই ‘টাইমলাইন’ বা সময়সীমা দেওয়া সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন তিনি।
ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (আইএমএ)-সহ সব চিকিৎসক সংগঠনের সঙ্গে বৈঠকে বসতে চেয়ে রবিবারই ইমেল করেছিলেন রাজ্যের মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ। সেই মর্মেই সংগঠনগুলিকে বৈঠকের কথা জানানো হয়। সোমবার দুপুর পৌনে ১টা নাগাদ স্বাস্থ্য ভবনে শুরু হয় বৈঠক। বৈঠকে মুখ্যসচিব ছাড়াও রাজ্য প্রশাসনের তরফে উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্রসচিব নন্দিনী চক্রবর্তী, রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা, স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিকর্তা। ঘটনাচক্রে, বৈঠকে অনুপস্থিত ছিলেন রাজ্যের স্বাস্থ্যসচিব নারায়ণস্বরূপ নিগম। প্রসঙ্গত, নিগমের অপসারণ চেয়ে সরব হয়েছেন আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের একাংশ। সেই আবহে তাঁর গরহাজিরা তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করা হচ্ছে।
সূত্র মারফত জানা যায়, বৈঠকে রাজ্যের স্বাস্থ্য প্রশাসনের নির্দিষ্ট একটি সমস্যা নিয়ে মুখ্যসচিবের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন সিনিয়র চিকিৎসকেরা। জবাবে মুখ্যসচিব জানান, তিনি এই বিষয়ে কিছু জানেন না। তখন বৈঠকে স্বাস্থ্যসচিবের অনুপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন সিনিয়র চিকিৎসকেরা। পন্থ জানান, বুধবার সুপ্রিম কোর্টে আরজি কর মামলার শুনানি। তাই দিল্লি গিয়েছেন নিগম।
বৈঠকে ছিলেন চিকিৎসকদের ১২টি সংগঠনের প্রতিনিধিরা। প্রতিটি সংগঠন থেকে দু’জন প্রতিনিধি বৈঠকে যোগ দেন। বৈঠকে স্বাস্থ্যসচিবের ইস্তফার প্রসঙ্গ তোলেন চিকিৎসক সংগঠনগুলির প্রতিনিধিরা। এর পাশাপাশি দক্ষিণ কলকাতার একটি পুজোমণ্ডপে ‘বিচার চাই’ স্লোগান দিয়ে গ্রেফতার হওয়া নয় আন্দোলনকারীর প্রসঙ্গও ওঠে। বৈঠকে সিনিয়র চিকিৎসকেরা শ্রীরামপুরের বিধায়ক তথা তৃণমূলের চিকিৎসক-নেতা সুদীপ্ত রায়কে রাজ্যের স্বাস্থ্য প্রশাসন থেকে অপসারণের দাবি তোলেন। সিনিয়র চিকিৎসদের দাবি, রাজ্য প্রশাসনের তরফে তাঁদের জানানো হয়, নির্বাচিত প্রতিনিধিকে এই ভাবে সরানো যায় না। প্রসঙ্গত, সুদীপ্ত রাজ্যের হেল্থ রিক্রুটমেন্ট বোর্ডের সদস্য। আরজি করের রোগী কল্যাণ সমিতির প্রাক্তন চেয়ারম্যানও বটে।
বৈঠক থেকে বেরিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন সিনিয়র ডাক্তারেরা। তাঁদের বক্তব্য, জুনিয়র ডাক্তারদের ১০ দফা দাবি পূরণের বিষয়ে কোনও লিখিত প্রতিশ্রুতি দেয়নি সরকার। তাই সরকার স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফেরানোর আর্জি জানালেও তা সম্ভব নয় বলেছেন সিনিয়র চিকিৎসকেরা। তাঁদের এক জনের কথায়, “থ্রেট কালচারে অভিযুক্তেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। দুর্নীতিগ্রস্ত লোকেরা স্বাস্থ্য প্রশাসনে বিভিন্ন পদে বসে রয়েছেন। পুলিশের ভূমিকা কী, তা তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। এর পরে কী ভাবে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফেরানো সম্ভব?”
সিনিয়র ডাক্তারদের তরফে রাজ্যের হেল্থ রিক্রুটমেন্ট বোর্ড এবং ওয়েস্ট বেঙ্গল মেডিক্যাল কাউন্সিলে দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হয়। ধর্মতলায় ‘আমরণ অনশনে’ বসা জুনিয়র ডাক্তারদের শারীরিক পরিস্থিতি নিয়েও উদ্বেগপ্রকাশ করা হয়। ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস ফোরাম’-এর সভাপতি কৌশিক চাকী বৈঠক শেষে বলেন, “আমি মুখ্যসচিবকে বললাম বাতানুকূল ঘরে বসে আলোচনা না করে জুনিয়র ডাক্তারদের অনশনমঞ্চে চলুন। আসলে সরকারের কাছে ইগো বড় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আমাদের জুনিয়র সহকর্মীদের কাছে প্রাণটা বোধ হয় অতটাও দামি নয়।” বৈঠকে রাজ্যের মেডিক্যাল কলেজগুলিতে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের প্রসঙ্গও ওঠে। নির্বাচন করানোর বিষয়ে মুখ্যসচিব আশ্বাস দিয়েছেন বলে জানান চিকিৎসক সংগঠনের প্রতিনিধিরা।
দুপুর পৌনে ১টা থেকে প্রায় আড়াই ঘণ্টা বৈঠক চলে। বৈঠক শেষে মুখ্যসচিব জানান, বৈঠকে যোগদানকারী সকলের বক্তব্য শুনেছে সরকার। সেগুলি নথিবদ্ধও করা হয়েছে। তাঁর কথায়, “১০টি দাবির মধ্যে সাতটির কাজ কিছুটা হয়েছে। কিছুটা চলছে। আমরা তার উপরে নজরদারি চালাচ্ছি। কী কী কাজ করা হয়েছে, আর কী কী বাকি রয়েছে, তা জানিয়ে আমরা স্টেটাস রিপোর্টও দিয়েছি।”
মুখ্যসচিব জানান, তিনটি দাবির বিষয়ে মতৈক্যে পৌঁছনো যায়নি। “জুনিয়র ডাক্তারদের মধ্যে ওঁরাও (সিনিয়র ডাক্তার) টাইমলাইন চাইলেন। আমরা পরিষ্কার বললাম, এই বিষয় নিয়ে টাইমলাইন দেওয়া সম্ভব নয়।” একই সঙ্গে তাঁর সংযোজন, রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতিতে পরিকাঠামো গত কাজের বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত, তা আমরা একসঙ্গে নিতে চাই। এই বিষয়ে সরকারের ভূমিকা ইতিবাচক।”
জুনিয়র ডাক্তারদের ‘আমরণ অনশন’ প্রত্যাহার করার আর্জি জানান মুখ্যসচিব। তিনি বলেন, “জুনিয়র ডাক্তারদের স্বাস্থ্য নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। আমরা তাঁদের অনশন প্রত্যাহার করে কাজে ফেরার অনুরোধ করছি।” মঙ্গলবার কলকাতায় দুর্গাপুজোর কার্নিভাল। ওই দিনই ‘দ্রোহের কার্নিভালে’র ডাক দিয়েছে চিকিৎসকদের যৌথ সংগঠন ‘জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অফ ডক্টর্স’। সোমবারের বৈঠকে ‘দ্রোহের কার্নিভালে’ যোগ দেওয়ার জন্য মুখ্যসচিবকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে বলে দাবি করেছেন সিনিয়র চিকিৎসকেরা।