(বাঁ দিক থেকে) মীরা পাণ্ডে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রাজীব সিংহ। — ফাইল চিত্র।
২০১৩ সালের ২ জুলাই। তার পর ২০২৩-এর ২০ জুন। ১০ বছর পর আরও এক বার বাংলার পঞ্চায়েত ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের রায় দিল (বা বহাল রাখল) সুপ্রিম কোর্ট। এ বারও শীর্ষ আদালত খারিজ করে দিল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের আবেদন। এই মিলগুলির পাশে অবশ্য সে বারে এবং এ বারে বড় অমিলও রয়েছে। এক দশক আগের সেই আইনি যুদ্ধে মুখোমুখি লড়াই হয়েছিল রাজ্য সরকার এবং রাজ্য নির্বাচন কমিশনের মধ্যে। বিরোধী দলগুলির ভূমিকা ছিল মূলত দর্শকের। সুপ্রিম কোর্টে সরকার হেরে গিয়েছিল কমিশনের কাছে। কিন্তু এ বার সরকার আর কমিশন এক দিকে। আইনি যুদ্ধে তাদের এক যোগে পরাজয় মানতে হল বিরোধীদের কাছে।
২০১৩ সালের পঞ্চায়েত ভোট স্মরণীয় হয়ে রয়েছে সরকার বনাম নির্বাচন কমিশনের (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বনাম মীরা পাণ্ডের) দীর্ঘ লড়াইয়ের জন্যই। এপ্রিলের গোড়া থেকে তুমুল দ্বন্দ্ব চলেছিল মূলত দু’টি বিষয়কে কেন্দ্র করে। এক, কত দফায় ভোট। দুই, ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়োগ। হাই কোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট হয়ে লড়াই শেষ হয় জুলাইয়ের গোড়ায়।
সে বার ‘ভোট পরিচালনার অধিকার’ নিয়ে রাজ্যের সঙ্গে মতবিরোধ তৈরি হতেই হাই কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন তৎকালীন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মীরা। কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন এবং ভোটের দফা নির্ধারণ নিয়ে হাই কোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চের রায় কমিশনের পক্ষে যায়। এর পর ডিভিশন বেঞ্চের দ্বারস্থ হয়েছিল রাজ্য। কিন্তু তার মধ্যেই সুপ্রিম কোর্টে চলে গিয়েছিলেন মীরা। শীর্ষ আদালতের রায়ও গিয়েছিল তাঁর পক্ষেই।
মামলার তদারকি করতে মীরা স্বয়ং দিল্লি গিয়েছিলেন। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি একে পট্টনায়ক এবং বিচারপতি রঞ্জন গগৈ (পরবর্তী কালে দেশের প্রধান বিচারপতি)-এর বেঞ্চে শুনানির আগে কমিশনের আইনজীবী ফলি নরিম্যান, মীনাক্ষী অরোরা এবং সমরাদিত্য পালের সঙ্গে ব্যক্তিগত স্তরে আলোচনা করে মামলার ‘গতিপ্রকৃতি’ সম্পর্কে অবহিত হয়েছিলেন।
২০১৩-র ভোটে ৮০০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়েছিল কমিশন। রাজ্য রাজি হয়নি। শেষ পর্যন্ত শীর্ষ আদালতের নির্দেশে ৮০০ কোম্পানিরও বেশি কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হয়। শুধু কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনই নয়, সে বার মীরা রাজ্য সরকারের সুপারিশ খারিজ করে পাঁচ দফায় পঞ্চায়েত ভোট করিয়েছিলেন। সেই ভোটে মালদহ, মুর্শিদাবাদ, জলপাইগুড়ির মতো জেলা পরিষদে জয় পেয়েছিল বিরোধীরা।
সুপ্রিম কোর্টে সেই জয়ের পরে আরও এক বছর রাজ্য নির্বাচন কমিশনের কুর্সিতে ছিলেন ১৯৭৪-এর ব্যাচের আইএএস মীরা। কিন্তু তাঁর জমানায় আর মেয়াদ উত্তীর্ণ ১৭টি পুরসভার ভোট করায়নি রাজ্য সরকার। কার্যকাল শেষ হওয়ার আগে মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া পুরসভাগুলিতে ভোট করানোর জন্য কলকাতা হাই কোর্টে মামলা করেছিলেন মীরা। সফল হননি। ২০১৪ সালের ২১ জুলাই অবসরের দিনে রাজ্যের সঙ্গে তাঁর ‘সংঘাতের’ বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করায় মীরা শুধু জানিয়েছিলেন, বামফ্রন্ট জমানায় ২০১০ সালের কলকাতা পুরভোটেও কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করতে পিছপা হননি তিনি।
মীরার পর রাজ্য নির্বাচন কমিশনার হন সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায়। তার পর আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় (অস্থায়ী)। তার পর অমরেন্দ্র কুমার সিংহ। তাঁর আমলেই ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত ভোট হয়। ঘটনাচক্রে তার পরের পঞ্চায়েত ভোটের মাথাতেও রয়েছেন আর এক সিংহ। রাজীব। এই দুই সিংহের মাঝে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার ছিলেন সৌরভ দাস।
রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যসচিব রাজীব সিংহ রাজ্য নির্বাচন কমিশনের মাথায় বসেন গত ৭ জুন। পর দিনই পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিন (এক দফায় ৮ জুলাই) ঘোষণা করে দেন। বিরোধীরা অভিযোগ তোলে, মনোনয়নের জন্য পর্যাপ্ত সময় দেয়নি কমিশন। প্রতিকার চেয়ে, এবং কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে ভোট করানোর দাবিতে হাই কোর্টে যায় সব বিরোধী দল। হাই কোর্টে প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ গত ১৩ জুনের রায়ে মনোনয়নের বিষয়টি কমিশনের উপর ছেড়ে দিলেও, রাজ্যে সব স্পর্শকাতর এলাকায় কেন্দ্রীয় বাহিনী নামানোর নির্দেশ দেয়। কিন্তু কমিশন এ নিয়ে কোনও উদ্যোগ নিচ্ছে না বলে অভিযোগ তোলে বিরোধীরা। ১৫ জুন নতুন করে নির্দেশ দিয়ে হাই কোর্ট বলে, রাজ্যের সব জেলায় কেন্দ্রীয় বাহিনী রাখতে হবে। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে বাহিনী চেয়ে আবেদনেরও নির্দেশ দেয় আদালত। পর দিন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব জানিয়েছিলেন, হাই কোর্টের নির্দেশ মেনেই পদক্ষেপ করবেন তিনি!
কিন্তু শেষ পর্যন্ত হাই কোর্টের নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে যায় কমিশন এবং রাজ্য। মঙ্গলবার শুনানির পর দুই আবেদনই খারিজ করে দিল বিচারপতি বিভি নাগরত্ন এবং বিচারপতি মনোজ মিশ্রের ডিভিশন বেঞ্চ। শীর্ষ আদালত জানিয়ে দিল, কলকাতা হাই কোর্টের দেওয়া রায়ই বহাল থাকছে। অর্থাৎ, প্রতি জেলায় কেন্দ্রীয় বাহিনী রেখেই ভোট পরিচালনা করতে হবে রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে।