ছবির মহিলার নাম উনজিলা বিবি। বাড়ি ডোমকলের রমনা শেখপাড়ায়। ভোটার তালিকায় স্বামীর নাম হয়ে গিয়েছে ডোমকল হসপিটাল।
ঘুমের আড়ালেও ভিনদেশি হয়ে যাওয়ার দুঃস্বপ্ন তাড়া করছে তাঁকে। মোস্তাকিন শেখের সাকিন যে এখন পড়শি বাংলাদেশ! অন্তত ভোটার কার্ডে তেমনই সিলমোহর পড়ে গিয়েছে।
এত দিন তা নিয়ে তেমন মাথাব্যথা ছিল না মুর্শিদাবাদের বাবলাবোনার বাসিন্দার। কিন্তু এনআরসি-র মেঘে ভয় জাঁকিয়ে বসেছে তাঁর বুকে। মোস্তাকিন বলছেন, ‘‘ঘুমের মধ্যেও মাঝেমাঝে আঁতকে উঠছি! সে দিন নাকি ঘুমের ঘোরে বলছিলাম, ‘আমায় নিয়ে চলল গো’! শুনে পাশের মানুষটা ভাবল ভূতে পেয়েছে!’’
ভোটার থেকে আধার কার্ড— নাম-ঠিকানা-বয়সের ভুলের গেরোয় এমনই ছটফট করছে মুর্শিদাবাদের সীমান্ত লাগোয়া একের পর এক গ্রাম। ভুল-নাম-ঠিকানার পরিচয়পত্র নিয়ে জেরবার মানুষ রাত জেগে হত্যে দিয়ে আছেন সংশোধনের লাইনে। কোথাও পুরুষ নামের পাশে মহিলার ঘোমটা টানা ছবি। কোথাও বা মহিলার নামের উপরে পোক্ত গোঁফের পুরুষ!
নাম আলেক শেখ। রেশন কার্ডে তা ভুল করে হয়ে গিয়েছে আসেক শেখ। বাড়ি ডোমকলের কুপিলায়।
ডোমকলের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের উনজিলা বিবি রাগে গরগর করছেন, ‘‘হাসপাতালে গেলে ওষুধ নেই, ডাক্তারের দেখা মেলে না। আর আমার স্বামীর নাম কিনা ডোমকল হসপিটাল!’’ উনজিলার দাবি, এত দিন ভুল ছিল তাঁর বিশ বছরের পুরনো পাড়ার নাম। নতুন ভোটার তালিকায় সেটুকু সংশোধন হল বটে। তবে এ বার নাম বিভ্রাটে স্বামীর পরিচয়টাই বদলে গিয়েছে! মতিউর শেখ রাতারাতি হয়ে গিয়েছেন ডোমকল হাসপাতাল!
আরও পড়ুন: ভোটার তালিকা সংশোধনের আর্জি ছাড়াল ৮০ লক্ষ
জলঙ্গির ভাদুরিয়া পাড়ার মমতাজ বিবিও নতুন ভোটার তালিকায় নিজের এবং মায়ের নাম দেখে আঁতকে উঠেছেন। সংশোধিত নতুন কার্ড আসার পরে দেখা যাচ্ছে তাঁর নাম দাঁড়িয়েছে, বীরেন্দ্রনাথ মণ্ডল খাতুন! আর ষাটোর্ধ্ব মা হয়েছেন মেঘনাদ মণ্ডল বিবি! মমতাজ বলছেন, ‘‘এ কী ছেলেখেলা হচ্ছে!’’ সাগরপাড়ার সচিন মণ্ডলের সমস্যাটা আবার আধার কার্ড নিয়ে। রাতারাতি তিনি তারকা হয়ে উঠেছেন। পদবি মণ্ডলকে উচ্ছেদ করে একেবারে ‘তেন্ডুলকর’ হয়ে গিয়েছেন তিনি। বাদ যাননি স্ত্রী সাধনা, তিনিও তেন্ডুলকর। বলছেন, ‘‘পাড়া দিয়ে হেঁটে গেলেই ছেলেছোকরারা চাপা আওয়াজ দিচ্ছে, কাকা আজকাল কিন্তু ব্যাটে রান নেই!’’
হাইকোর্টে ঘনঘন মামলা করার বাতিক ছিল ইসলামপুরের মোল্লাডাঙার আসরফ মণ্ডলের। পাড়া পড়শি তাঁকে ‘হাইকোর্ট চাচা’ বলে চিনতেন। আধার কার্ড হাতে পেয়ে চমকে উঠেছেন তিনি। সেখানেও স্পষ্ট হরফে লেখা ‘হাইকোর্ট মণ্ডল!’
মরিয়া হয়ে তিনি এখন আসরফে ফিরতে চাইছেন। উপায়? ডোমকলের মহকুমাশাসক সন্দীপ ঘোষ বলছেন, ‘‘আধার কার্ডের ব্যাপারে আমাদের তো করণীয় কিছু নেই। সংশোধন যেখানে হচ্ছে সেখানে গিয়েই ফর্ম ৮ পূরণ করে আবেদন করতে হবে।’’ আবেদন তো করতে হবে, কিন্তু কেন এমন ভাবে নাম-ঠিকানা বদলে গেল?
জেলা প্রশাসনের এক কর্তাও রাগে গজরাচ্ছেন, ‘‘অত্যন্ত নিম্নমানের অপারেটর দিয়ে ভোটার লিস্ট তৈরি করালে যা হয় তা-ই হয়েছে। এত মানুষের হয়রানির দায় এখন কে নেবে!’’