মণীশ শুক্ল খুনের প্রতিবাদে রাজভবনে বিজেপি নেতারা। তাঁদের সঙ্গে কথা বলছেন রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়। সোমবার। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক
রাজনৈতিক নেতা খুন হলে প্রতিপক্ষের দিকে আঙুল ওঠাই স্বাভাবিক। টিটাগড়ের বিজেপি নেতা মণীশ শুক্লর খুনের পরে সে ভাবেই সোমবার দিনভর শাসক তৃণমূলের বিরুদ্ধে অভিযোগে সরব থেকেছেন বিজেপির শীর্ষ নেতারা। এমনকি, সন্ধ্যায় রাজভবনে গিয়ে রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ের কাছে সিবিআই তদন্তের দাবিও জানিয়ে এসেছেন কৈলাস বিজয়বর্গীয়রা। জেলা সফরে ব্যস্ত বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষও ওই ঘটনায় তৃণমূল জড়িত বলে সরাসরি অভিযোগ তুলে বলেছেন, ‘‘এ ভাবেই ওরা আমাদের দলের লোকেদের ভয় দেখাতে চাইছে।’’
এর পাশাপাশি বিভিন্ন সূত্রে ঘটনার যে বিশ্লেষণ পাওয়া যাচ্ছে, তাতে এই খুনে তৃণমূল না বিজেপি, কার ‘উদ্দেশ্য’ সিদ্ধ হল, তা নিয়ে যথেষ্ট ধোঁয়াশা সামনে আসছে। এমনকি, এটি কোনও পুরনো বিবাদের জের কি না, উঠছে সে প্রশ্নও। ধোঁয়াশার সূত্রপাত ঘটনার বিবরণ থেকে। জানা যাচ্ছে, রবিবার মণীশের সঙ্গে একই গাড়িতে ছিলেন বিজেপি সাংসদ অর্জুন সিংহ। কৈলাস অর্জুনকে ফোন করে ডাকলে তিনি ওই গাড়ি থেকে নেমে যান। মণীশ গাড়ি চড়ে চলে যান টিটাগড়। সেখানেই চায়ের দোকানে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। মণীশের ব্যক্তিগত দুই নিরাপত্তারক্ষীই ওই দিন একই সঙ্গে ছুটিতে ছিলেন। লাইসেন্স সংক্রান্ত কিছু কারণে গত ছ’মাসের বেশি পুলিশের কাছে জমা রয়েছে মণীশের রিভলভার। সব মিলিয়ে তিনি কিছুটা অরক্ষিতই ছিলেন।
প্রশ্ন উঠছে, এই পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল বলেই কি আততায়ীরা ওই সময়ে আক্রমণের ছক কষেছিল? অনেকের ধারণা, মণীশের ঘনিষ্ঠ বৃত্তের লোকজন ছাড়া আর কারও পক্ষে এত বিশদ খোঁজখবর রাখা কঠিন। সে ক্ষেত্রে তাঁর চারপাশের ঘনিষ্ঠদের দিকেই সন্দেহের তির কিছুটা ঘুরে যায়। যদিও কারা এই ঘনিষ্ঠের দলে এখনই তার স্পষ্ট কোনও ব্যাখ্যা মেলেনি।
আরও পড়ুন: মণীশ-হত্যা ঘিরে তপ্ত কলকাতাও, তিক্ত বাগ্যুদ্ধে অর্জুন-ফিরহাদ
মণীশ অর্জুনের ঘনিষ্ঠ বলেই পরিচিত। অর্জুন নিজেও সোমবার বলেছেন, ‘‘আমার নিজের ভাই নেই। মণীশই আমার ভাই।’’ তবে স্থানীয় সূত্রের দাবি, মণীশ তাঁর নিজস্ব রাজনৈতিক ভিত মজবুত করে রাজনীতিতেই আরও প্রতিষ্ঠা পেতে চাইছিলেন। সে ক্ষেত্রে তিনি কি ব্যারাকপুরে বিজেপির অন্দরে আর একটি ‘সমান্তরাল শক্তি’ হয়ে উঠতে চাইছিলেন? রাজনৈতিক মহলে মণীশ-খুনের বিশ্লেষণে এই তত্ত্বও সামনে আসছে। যদিও এ সব নিয়ে দলের মধ্যে কেউই মুখ খুলতে চাননি।
অন্য দিকে, তৃণমূল নেতা ও মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের দাবি, মণীশ বিজেপিতে অশান্তিতে ছিলেন এবং তৃণমূলে ফিরতে চেয়ে নানা সূত্রে যোগাযোগের চেষ্টা শুরু করেছিলেন। তৃণমূলের উপরে মণীশ-হত্যার দায় চাপানোর বিরোধিতা করে ফিরহাদ আরও বলেন, ‘‘তৃণমূল খুনের রাজনীতি করে না।’’ শাসক দলের এই শীর্ষ নেতার আরও বক্তব্য, ‘‘বিজেপির লোক খুন হলে তৃণমূলের উপরে তার দায় চাপানোর চেষ্টা হবে, এটা বুঝেও তৃণমূল সেই পথে পা বাড়াতেই বা যাবে কেন?’’ তাঁর প্রশ্ন, মণীশ তৃণমূলে ফেরার চেষ্টা করছিলেন বলেই কি তাঁকে মারা হল?
আরও পড়ুন: ১৪ বুলেটে ঝাঁঝরা মণীশের দেহ, ১ আততায়ী শনাক্ত, ধৃত ২
মণীশ-হত্যার বিষয়টিকে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব হাথরস-মোকাবিলার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতেও নেমে পড়েছেন। দলের কেন্দ্রীয় মুখপাত্র সম্বিৎ পাত্র এ দিন দিল্লিতে বলেন, ‘‘অন্য রাজ্যে কিছু হলেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অন্যায়-অবিচারের অভিযোগ তুলে সেখানে পৌঁছে যান। তাঁকে প্রশ্ন করি, আপনি কবে মণীশের বাড়ি যাবেন?’’ রাজ্যে কোনও আইনশৃঙ্খলা নেই বলেও তাঁর অভিযোগ।
পুলিশের খাতায় মণীশের বিরুদ্ধে এখনও বহু অভিযোগ ঝুলছে। পুলিশ তদন্তে নেমে জেনেছে, বছর দুয়েক আগে মণীশের ডান হাত সতীশ মিশ্রকে টিটাগড়ে বি টি রোডের ধারে গুলি করে খুন করা হয়। তখন মণীশ এবং অর্জুন তৃণমূলে। তাঁদের অভিযোগের ভিত্তিতে স্থানীয় এক প্রভাবশালী ব্যবসায়ীকে তখন গ্রেফতার করা হয়েছিল। মণীশ-খুনের ঘটনার সঙ্গে সেই পুরনো বিবাদের কোনও যোগসূত্র আছে কি না, সেটিও খতিয়ে দেখছে পুলিশ। ইতিমধ্যে আর একটি খোঁচা দিয়ে মন্ত্রী ফিরহাদের দাবি, ‘‘মণীশ-হত্যায় যে ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে বলে শুনছি, তা এ রাজ্যের দুষ্কৃতীরা সচরাচর ব্যবহার করে না।’’
অর্জুনের অভিযোগ, ‘‘মণীশের খুনে পুলিশ জড়িত। যে অস্ত্র মিলেছে, সেটা পুলিশের। তাই আমরা রাজ্যপালের কাছে গিয়ে সিবিআই তদন্ত চেয়েছি। তিনি যা করার, সাধ্যমতো করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন।’’ উপযুক্ত তদন্তের দাবি তুলেছেন ফিরহাদও। তবে রাজ্য এখনও সিবিআই তদন্তের কোনও আভাসই দেয়নি। বরং, ফিরহাদের বক্তব্য, ‘‘সিবিআই তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেলও ফেরাতে পারেনি!’’ রাজ্য প্রশাসনের সূত্রের মতে, সিবিআইকে ডাকতে পারে রাজ্য। কোর্টের নির্দেশ থাকলে সিবিআই তদন্ত হতে পারে। রাজ্যপালের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে কী, সেটা এখনই বোঝা যাচ্ছে না।
যদিও মণীশের হত্যা নিয়ে যাবতীয় সংশয় উড়িয়ে দিলীপবাবু বলেন, ‘‘এটা যে তৃণমূলের কাজ, তাতে সন্দেহ নেই। কারণ আমাদের এক লড়াকু কর্মীর জীবন গেলে প্রতিপক্ষেরই লাভ।’’ ঘটনার দিন মণীশের দেহরক্ষী না থাকার প্রশ্নে অবশ্য দিলীপবাবুর সদুত্তর মেলেনি। এমনকি, রাজ্যে কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা পাওয়া বিজেপির লোকজনদের দীর্ঘ তালিকায় অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত ব্যক্তিরা থাকলেও মণীশ কেন ছিলেন না, তারও স্পষ্ট জবাব দিলীপবাবু দেননি। তাঁর বক্তব্য, ‘‘এ সবে আমার ভূমিকা নেই।’’