—প্রতীকী ছবি।
স্কুলে নিয়োগ দুর্নীতিতে ইতিমধ্যেই রাজ্যের এক মন্ত্রী ও দুই বিধায়ক জেলে। মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। দুই বিধায়ক মানিক ভট্টাচার্য ও জীবনকৃষ্ণ সাহা। সোমবার কলকাতা হাই কোর্টে পেশ করা রিপোর্টে সিবিআই জানাল, ওই দুর্নীতিতে যুক্ত আরও বেশ কয়েক জন বিধায়ক এবং পুরপ্রতিনিধি (কাউন্সিলর)।
এ দিন সিবিআইয়ের জমা দেওয়া ওই রিপোর্টে চোখ বুলিয়ে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রশ্ন, ‘‘এঁরা তো সব মহাপুরুষ! এঁদের কবে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন?’’ খানিকটা তির্যক সুরে তাঁকে প্রশ্ন করতে শোনা যায়, ‘‘লোকসভা ভোট ঘোষণা হলে ডেকে পাঠাবেন?’’ জবাবে সিবিআইয়ের কৌঁসুলি অবশ্য জানান, কয়েক জনকে ইতিমধ্যেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। রিপোর্টে অভিযুক্ত বিধায়ক-কাউন্সিলরদের প্রসঙ্গে বিচারপতির মন্তব্য, ‘‘জানি, অনেকেই সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা পরে ঘোরেন অথচ দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত।’’ সেই সঙ্গে সিবিআইকে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের পরামর্শ, ‘‘কড়া পদক্ষেপ করুন। পাখির পালক দিয়ে হাওয়া করলে হবে না।’’
সিবিআইয়ের তরফে এ দিন তদন্ত-রিপোর্ট জমা দেন কেন্দ্রের ডেপুটি সলিসিটর জেনারেল বিল্বদল ভট্টাচার্য। সেখানে কাদের নাম রয়েছে, তা সিবিআইয়ের কৌঁসুলি বা বিচারপতি কেউই প্রকাশ করেননি। কিন্তু আইনজীবী মহলের প্রশ্ন, যদিএকই অপরাধে পার্থ, মানিক, জীবন জেলে থাকতে পারেন, তা হলে বাকিদের গ্রেফতারে অসুবিধা কোথায়? আর এখানেই সিবিআই তদন্তের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন তাঁরা।
সিবিআইয়ের তদন্তের ফাঁক-ফোকর নিয়ে ইদানীং প্রশ্ন উঠছে প্রায় নিয়মিত। এ দিন ক্ষুব্ধ বিচারপতি প্রশ্ন তুলেছেন মানিক এবং সিবিআইয়ের আঁতাত আছে কি না। তিনি বলেন, ‘‘মানিকের সঙ্গে সিবিআই অফিসারদের বোঝাপড়া হয়েছিল নাকি? তাই কি মানিক সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে রক্ষাকবচ নিতে পেরেছেন?’’ সুুপ্রিম কোর্টে মানিকের রক্ষাকবচ প্রত্যাহারের আর্জি জানানো হয়েছে কি না, তা-ও সিবিআইয়ের কাছে জানতে চেয়েছেন বিচারপতি। তাঁর পর্যবেক্ষণ, সুুপ্রিম কোর্ট ২০২২ সালে রক্ষাকবচ দিয়েছিল। তার পরে প্রায় এক বছর কেটে গিয়েছে। তা হলে এখনও রক্ষাকবচ প্রত্যাহারের আর্জি জানানো হয়নি কেন?
বিচারপতির বক্তব্যে ইঙ্গিত, মানিককে আরও ভাল করে জেরার তথ্য রিপোর্টে না থাকায় তিনি ক্ষুব্ধ। তদন্ত-রিপোর্ট দেখার পরে তিনি বলেন, ‘‘সিজার লিস্ট দেখতে চাই। এগুলি দেখার পরে তো বলাই যায় যে, যাবতীয় দুর্নীতি মানিক ভট্টাচার্য করেছেন।’’ মানিককে জেরায় ‘ফাঁকফোকর’ নিয়ে বিচারপতির প্রশ্ন, ‘‘কেন বিস্তারিত ভাবে জিজ্ঞাসা করেননি? কী ধরনের তদন্ত এটা? আমার দিকে তাকিয়ে বসে আছেন! নিজে থেকে উদ্যোগী হননি। আপনাদের আদৌ কি মনে হয়যে, এটা গুরুত্বপূর্ণ একটা ঘটনা? ইডি-কে কিছু ‘শেয়ার’ করেছেন (অর্থাৎ, তদন্তে পাওয়া তথ্য ইডি-র সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছেন)? দেখা যাচ্ছে, একটি সংস্থা এবং মানিক ভট্টাচার্য সম্পর্কে দ্রুত তদন্ত করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তা হয়েছে? কিছু তথ্য পেয়েছেন কি না,সেটাই জানতে চাই। এগুলো তো মামুলি প্রশ্ন!’’
২০১৪ সালের টেট-এর উত্তরপত্র (ওএমআর শিট) বিকৃতি সংক্রান্ত মামলায় এই রিপোর্ট তলব করেছিলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। তবে সেই প্রসঙ্গে সিবিআইয়ের রিপোর্টে এ দিন মোটেও সন্তুষ্ট হননি তিনি। তাঁর মন্তব্য, “ওএমআর শিট কী ভাবে নষ্ট করা হল, তার তদন্ত বন্ধ কেন? শীর্ষ আদালত মানিক ভট্টাচার্যকে রক্ষাকবচ দিলেও তদন্তে তো বাধা দেয়নি। তার পরেও কেন সিবিআইয়ের কাজ বন্ধ?” মানিককে কত বার জেলে গিয়ে জেরা করা হয়েছে, সেই প্রশ্নও জানতে চান তিনি। সিবিআইয়ের আইনজীবী অবশ্য দাবি করেন, মানিককে পাঁচ বার জেরা করা হয়েছে। তার মধ্যে দু’দিনের ভিডিয়ো রেকর্ডিং আছে। বাকি তিন দিনের রেকর্ডিং এবং কিছু বয়ানে মানিকের স্বাক্ষর নেই। কেন তা নেই, উঠেছে সেই প্রশ্নও।
বস্তুত, প্রায় দেড় বছর ধরে নিয়োগ দুর্নীতির তদন্ত চললেও এখনও তা নিয়ে বহু প্রশ্ন রয়েছে সাধারণ মানুষের মনে। অতীতে সারদা তদন্তের পরিণতি দেখেছেন রাজ্যের মানুষ। তাই নিয়োগ দুর্নীতির তদন্ত শেষে কালের গর্ভে বিলীন হবে কি না, সেই প্রশ্নও উঠছে মানুষের মনে।
এ দিন বিচারপতির কথাতেও যেন তার প্রতিধ্বনি শোনা গিয়েছে। সিবিআইয়ের উদ্দেশে তিনি বলেন, মানুষ ক্রমশ এই তদন্তের উপরে আস্থা হারিয়ে ফেলছে। নিম্ন আদালতে দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া শুরু হওয়া প্রয়োজন। তদন্তকারী সংস্থার উদ্দেশে বিচারপতির মন্তব্য, ‘‘আপনারা মুখে বলছেন, আদালতের নজরদারিতে তদন্ত হচ্ছে। অথচ আদালতকেই কার্যত কাঁচকলা দেখাচ্ছেন।’’
হাই কোর্টের তথ্য অনুযায়ী, আগামী বছরের অগস্টে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের অবসর নেওয়ার কথা। এ দিন বিচারপতি কার্যত সে কথা টেনে বলেছেন, ‘‘সবাই অপেক্ষা করে আছে, আমি কবে অবসর নেব। আমি অবসরে যাব না। মাঝেমধ্যে ভাবি, সুন্দরবন পর্যন্ত পদযাত্রা করব। কিছু বলব না, শুধু হেঁটে যাব।’’
বিচারপতির এই মন্তব্য অবশ্য নানা জল্পনার জন্ম দিয়েছে। অনেকের মতে, বিচারপতির আসন থেকে অবসর নিলেও, দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান থেকে যে তিনি সরবেন না, কার্যত সে কথাই হয়তো বোঝাতে চেয়েছেন তিনি। এর আগে এবিপি আনন্দকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন যে, অবসরের পরে মানুষকে সমাজ, রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন করার কাজও করতে পারেন। সুন্দরবন পর্যন্ত পদযাত্রার সঙ্গে সেই সচেতনতার কোনও সম্পর্ক আছে কি না, তা নিয়েও নানা মহলে জল্পনা শুরু হয়েছে।
উল্লেখ্য, প্রাথমিকে নিয়োগের দু’টি মামলা সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পরে বিচারপতি অমৃতা সিংহের এজলাসে স্থানান্তরিত হয়েছে। কিন্তু বাকি মামলা এখনও বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাসেই আছে। তার মধ্যে অন্যতম এই উত্তরপত্র বিকৃতির মামলা। এই মামলাতেই গত ১১ সেপ্টেম্বর রিপোর্ট দেওয়ার কথা ছিল সিবিআইয়ের। সেই রিপোর্ট জমা দেওয়াকে কেন্দ্র করে নিয়োগ দুর্নীতির পরিমাণ বোঝাতে আমেরিকার আকাশচুম্বী ‘ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের’ উপমা দিয়েছিলেন সিবিআইয়ের কৌঁসুলি। পরে তার সঙ্গে জুড়েছে দুবাইয়ের ‘বুর্জ খলিফা’র উদাহরণও।