আখড়ায় মনসুর ফকির। নিজস্ব চিত্র
দূর থেকে শোনা যাচ্ছে দোতারার আওয়াজ, ফকিরি সুর। পায়ে পায়ে কাছে আসতে তা আরও স্পষ্ট। ‘‘আমার নিতাই চাঁদের বাজারে, গৌর চাঁদের দরবারে, এক মন যার সেই যেতে পারে...।’’ বাবা আজহার ফকিরের সমাধির সামনে গাইছেন মনসুর ফকির।
বাবার সমাধিকে ঘিরেই মনসুরের আখড়া। দ্বাদশ শতকে বেশ কয়েকটি পাঠান পরিবার আফগানিস্তান থেকে ভারতে এসে বসতি স্থাপন করে। তার মধ্যে একটি এসেছিল মালদহের গৌড়ে। মহাপ্রভুর সময়কালে সেই পরিবারের সদস্যরাই গৌড় থেকে আসেন নদিয়ায়। সেই থেকেই গ্রামের নাম গৌড়ভাঙা, কালক্রমে যা হয়ে গিয়েছে গোড়ভাঙা। বিধানসভা তেহট্ট। এখন সেই গ্রামে শ’খানেক পরিবার ফকিরি গানের শিল্পী। পান রাজ্য সরকারের শিল্পী ভাতাও।
প্রতি বছর ১৯ ফেব্রুয়ারি আজহার ফকিরের জন্মদিন উপলক্ষে মেলা বসে। নাম সম্প্রীতি উৎসব। তার আয়োজন দেখভালের ফাঁকেই বলে চলেন মনসুর, ‘‘এ মাটি মহাপ্রভুর মাটি। এখানে বিভেদের ঠাঁই নাই।’’ মহাপ্রভুর সঙ্গে মহম্মদের কথার মিল খুঁজে পেয়েছেন মনসুর। বলেন, ‘‘দু’জনেই তো ঘরে ঘরে ধর্মাচরণের কথা বলেছেন। ধর্মাচরণের জন্য মন্দির, মসজিদে যাওয়ার কী দরকার? এই বিভাজন তো মানুষের তৈরি।’’
বিভাজন তখন হয়নি দেশেরও। অবিভক্ত নদিয়ার সদর ছিল বাংলাদেশের কুষ্টিয়া। সেখানকার জমিদারি সেরেস্তায় যোগাযোগের সৌজন্যে লালন আখড়ার বাউল-ফকিরদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল মনসুরের ঠাকুর্দা মাতব্বর আলি খানের। তাই তাঁদের সুরে এক হয়ে গিয়েছে বাউল-ফকির দুই মনন। সেই ‘হরে কৃষ্ণ হরে হরে’ এখন ভোটেরও বুলি। আপনাদের কথা নেতারা নিয়ে নিচ্ছেন নাকি? প্রশ্ন শুনে হাসেন মনসুর। ‘‘আমরা তো সমুদ্র। সমুদ্র থেকে জল নিলে কি সমুদ্র শেষ হয়? না বাধা দেয়?’’
বিএসএফ বাধা দেয়। যে ভারতীয় নাগরিকদের জমি রয়েছে সীমান্তের ওপারে, সেগুলিতে চাষবাসের কাজে যেতে। সব সময় নয়। তবে মাঝে মাঝে খুব কড়াকড়ি হয়। বলছিলেন গোড়ভাঙার কাছেই আর একটি গ্রাম, বিষ্টুগঞ্জের বাসিন্দা পলাশ ভক্ত।
একেবারে বাংলাদেশ সীমান্তের কাঁটাতার লাগোয়া গ্রামটি। রাজ্য সড়ক থেকে গ্রামে ঢোকার রাস্তাটি পাকা। গোড়ভাঙার মতোই। বিদ্যুৎ, জলের ব্যবস্থাও আছে। রাস্তা ধরে একটু এগোলেই বাঁ দিকে বিরসা মুন্ডার পূর্ণাবয়ব মূর্তি। এত দিন ছিল না। ক’দিন আগেই তা উদ্বোধন করেছেন তেহট্টের তৃণমূল বিধায়ক গৌরীশঙ্কর দত্ত। পাশেই সরস্বতী পুজো হয়েছে।
রাস্তা ধরে এগোলে পাকা স্কুলবাড়ি। তার পরেই নিজের বাড়ির সামনে শ্রমিকদের সঙ্গে কাঠের কাজে সাহায্য করছিলেন পলাশ। ভিন্ রাজ্যে কাজ করলেও লকডাউনের পর থেকে গ্রামেই রয়েছেন। তবে এখানকার থেকে বাইরে মজুরি বেশি। বাড়ি কিছুটা পাকা, কিছুটা টিনের। বললেন, ‘‘গ্রামে শান্তিতেই থাকে সবাই। আমি নমশূদ্র। আমরা আছি। মুসলিম, আদিবাসী সবাই রয়েছে।’’ নিজের জমি নেই। অন্যের জমিতে কাজ করছেন পলাশ।
বিএসএফের কড়াকড়ি থাকলেও কাঁটাতার থাকায় অপরাধ কমেছে বলে মত পলাশের। বললেন, ‘‘আগে দুষ্কৃতীরা ওপার থেকে এসে ডাকাতি করে পালিয়ে যেত, এখন সেটা নেই। আসলে কয়েকজনের অপরাধ করার জন্য বিএসএফ সবার উপরে কড়াকড়ি করে।’’ পুরো কথাটা যেন বলতে চেয়েও গিলে নিলেন তিনি। এলাকা জুড়ে চাষবাস ভালই হয়। ধান, গম তো বটেই, প্রচুর কলা খেত রয়েছে। আনাজ ভাল হয়। কলা, পটল, কুমড়ো বাইরেও যায়। চাষের নতুন আইন হলে কেমন হবে? পলাশ বললেন, ‘‘খবরে তো দেখি পঞ্জাবের বিক্ষোভের কথা। তবে প্রধানমন্ত্রী তো বলছেন ভাল হবে। উনি নিশ্চয়ই ভালই চাইবেন।’’
রাস্তা শেষ হয়ে গিয়েছে কাঁটাতারের কাছে। একটু আগেই মুদিখানায় বসে আসগর মহলদার। পাকা বাড়ি। ছেলে কুয়েতে শ্রমিকের কাজ করে। জমি রয়েছে। রেশনের চাল পান, স্বাস্থ্যসাথী কার্ডও হয়েছে। বললেন, ‘‘আল্লার রহমতে শান্তিতেই আছি। জাত-ধর্ম মিলেমিশেই থাকি।’’
আসগরের দোকানেই সামনে দিয়েই মাথায় কাঠকুটো কুড়িয়ে বেঁধে নিয়ে ফিরছিলেন জনা পাঁচেক মহিলা। পিঙ্কি মুন্ডারি, ঝর্না মুন্ডারিরা জানালেন, স্বাস্থ্যসাথী কার্ডের আবেদন করলেও এখনও কার্ড হাতে পাননি। তবে গ্রামের চেহারা অনেক ভাল হয়েছে। ভোট আসছে তো, কী বুঝছেন? হাঁটতে হাঁটতেই ঝর্না বললেন, ‘‘দিদি-মোদী যেই আসুক, আমাদের তো কাজ করেই খেতে হবে।’’ কে জিতবে? পিঙ্কির জবাব, ‘‘তা কি বলা যায়? তবে ঠিক জায়গায় ভোট দেব।’’ মাথায় বোঝা নিয়ে যেতে যেতেই আসগরের সঙ্গে কুশল বিনিময় হল তাঁরা।
নিস্তরঙ্গ জীবনে এই দৈনন্দিন সহাবস্থান চোখে পড়ে। কিন্তু চোখের আড়ালেও কি কিছু রয়ে যায়? যেমন শ্যাওলাঢাকা জলঙ্গি দেখে বোঝা দায় তলায় থাকা স্রোতের অস্তিত্ব। কিছু অবশ্য চোখের সামনেই দেখা গেল। যেমন কৃষ্ণনগর-করিমপুর রাজ্য সড়কে উপরে মতুয়া সম্মেলনের একাধিক তোরণ। তাতে বিজেপি সাংসদ শান্তনু ঠাকুরের ছবি প্রকট। তাঁদের মন পেতে চায় সব দল। রাজ্য সড়কের ধারে বেতাই কলেজ চত্বরে ঢুকেও দেখা গেল বসেছে হরিচাঁদ-গুরুচাঁদের মূর্তি। অতি সম্প্রতি। কারণ, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির চেয়েও ধর্ম, জাতের সমীকরণে ভোটের অঙ্ক জটিল।
এবং কলেজে হরিচাঁদ-গুরুচাঁদের নতুন মূর্তির সঙ্গেই একই ফ্রেমে রয়েছে বি আর অম্বেডকরের পূর্ণাবয়ব মূ্র্তিও। কলেজের নামও অম্বেডকরের নামে। অম্বেডকরের জাতপাত-বিরোধী বার্তা লেখা রয়েছে দেওয়ালে। কানে বাজে মনসুর ফকিরের আখড়ায় শুনে আসা গান, ‘‘লালন বলে জাতের কি রূপ, দেখলাম না এই নজরে....।’’