মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও প্রশান্ত কিশোর।—ফাইল চিত্র।
চমকে দিল বৈঠকের খবরটা। তার পর থেকে দিন দুয়েক ধরে বাংলার রাজনীতিতে সবচেয়ে চর্চিত নাম হয়ে উঠলেন প্রশান্ত কিশোর। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ মহল বলছে, এত চর্চার কিছু নেই। প্রশান্ত কিশোরকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হবে না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনীতি। প্রশান্তের বাণী অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করার প্রশ্নই নেই। বিজেপি-কে সজোরে প্রত্যাঘাত করতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যত রকমের ঘুঁটি সাজানো শুরু করেছেন, প্রশান্ত কিশোর সে ঘুঁটিগুলোর অন্যতম হয়ে উঠবেন মাত্র।
লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার দু’সপ্তাহের মধ্যে দেশের সবচেয়ে নামী পেশাদার ইলেকশন স্ট্র্যাটেজিস্টকে কলকাতায় ডেকে একটা বিষয় খুব স্পষ্ট করে দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পিছু হঠার বা ব্যাকফুটে দাঁড়িয়ে খেলার প্রশ্নই নেই। বরং বাংলার রণক্ষেত্রে বিজেপি-কে সব দিকে দিয়ে ঘিরে ফেলার আয়োজন শুরু করে দিয়েছেন তিনি।
লোকসভা নির্বাচনে যে ধাক্কা তৃণমূল খেয়েছে, তা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে যে প্রত্যাশিত ছিল না, সে নিয়ে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের খুব একটা দ্বিমত নেই। কিন্তু অপ্রত্যাশিত ধাক্কাটা খেয়েছেন বলেই মমতা এ বার আরও বেশি সতর্ক। নিজেকে এবং দলকে খুব দ্রুত আরও অনেকটা গুছিয়ে নিয়ে আগামীর লড়াইটা এখন থেকেই শুরু করে দিতে চাইছেন তিনি। সেই কারণেই প্রশান্ত কিশোর এবং রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন আসার দু’বছর আগেই প্রশান্ত কিশোর।
আরও পড়ুন: একের পর এক বড় ঘোষণায় দিনভর ঝাঁকুনি দিলেন পুরনো মেজাজের মমতা
কখনও নরেন্দ্র মোদী, কখনও নীতীশ কুমার, কখনও জগনমোহন রেড্ডিকে বিপুল নির্বাচনী সাফল্য এনে দেওয়া প্রশান্ত কিশোর কখনও ব্যর্থ হননি, এমন নয়। রাহুল গাঁধীর হয়ে উত্তরপ্রদেশের ময়দান সামলাতে নেমেছিলেন তিনি ২০১৭ সালে। কংগ্রেসের ফলাফল সে রাজ্যে আগের চেয়েও খারাপ হয়েছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সে সব রেকর্ড সম্পর্কে কি অবগত নন? খুব অবগত। কিন্তু ওই রেকর্ডে মমতার খুব একটা যায়-আসে না, বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাঁদের মত হল, রাজনৈতিক ভাবে প্রশান্ত কিশোরের উপরে নির্ভরশীল হয়ে ভোটে লড়ার কথা মমতা ভাবছেনই না। মমতা শুধু ভাবছেন নিজের দুর্গটাকে আরও দুর্ভেদ্য করে তোলার কথা। তার জন্য যত রকমের অস্ত্রশস্ত্র মোতায়েন করা দরকার, সব রকমই মমতা করবেন।
আরও পড়ুন: কেন্দ্রের সঙ্গে সঙ্ঘাত জারি, মোদীর ডাকা নীতি আয়োগ বৈঠকে যাচ্ছেন না মমতা
লোকসভা নির্বাচন মেটার পর থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একাধিক বার সংবাদমাধ্যমের সামনে এ কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, বিধানসভা আসন ভিত্তিক ফলাফলে গরিষ্ঠতা এই নির্বাচনেও তৃণমূলই পেয়েছে। তৃণমূল সূত্রের খবর, সেই গরিষ্ঠতা ধরে রাখার বিষয়ে মমতা এখনও অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী। তবে আত্মসন্তুষ্ট হতে তিনি একেবারেই রাজি নন। বরং বিধানসভা নির্বাচনের আগে যে দুটো বছর এখনও হাতে রয়েছে, সেই দু’বছরে প্রশাসনিক এবং সাংগঠনিক ভাবে আরও দুর্ভেদ্য হয়ে উঠে বিজেপির সঙ্গে নিজের ব্যবধান ক্রমশ বাড়িয়ে নেওয়াই তাঁর লক্ষ্য। সেই লক্ষ্য পূরণের জন্য তূণীরে যত রকম অস্ত্র ভরে রাখা দরকার, তত রকম অস্ত্রই তিনি সযত্নে জমাতে শুরু করে দিয়েছেন এখন থেকে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ ২০০৯ সালের বামেদের সঙ্গে ২০১৯ সালের তৃণমূলের তুলনা শুরু করেছেন। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইতিমধ্যেই বুঝিয়ে দিতে শুরু করেছেন যে, বামেদের সঙ্গে কেন, দেশের আর কোনও রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গেই নিজের তুলনা হতে দেবেন না তিনি।
২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল, কংগ্রেস ও এসইউসিআই-এর জোটের কাছে বিরাট ধাক্কা খেয়ে বামফ্রন্ট মানসিক ভাবে আত্মসমর্পণ করতে শুরু করে দিয়েছিল। পরাজয় অমোঘ, ধীরে ধীরে তলিয়ে যাবে জনভিত্তি— ধরেই নিয়েছিলেন বিভিন্ন স্তরের অনেক বাম নেতা। লালঝান্ডার ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা সেখানেই অনেকখানি শেষ হয়ে গিয়েছিল।
২০১৯ সালের তৃণমূল ২০০৯ সালের সেই বামেদের সঙ্গে যে তুলনীয় নয়, অনুচ্চারেই সে কথা খুব পরিষ্কার ভাবে বুঝিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়াটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চালু করে দিয়েছেন। সপ্তাহ খানেক সময় নিয়েছেন পরিস্থিতিটা মেপে নিতে। তার পরেই পুরনো অবতারে ফিরেছেন মমতা। ফিরেছেন সেই মমতায়, কর্মীর উপরে হামলার খবর পেলেই যিনি ছুটে যেতেন ঘটনাস্থলে, নিরন্তর জনসংযোগে থেকে যিনি সব সময় বাড়িয়ে রাখতেন প্রতিপক্ষের রক্তচাপ, যে কোনও প্রতিপক্ষের সঙ্গে চূড়ান্ত সঙ্ঘাতে যেতে যাঁর জুড়ি ছিল না, যে কোনও লক্ষ্যে পৌঁছনোর প্রশ্নে যে মমতা আপোসহীন ছিলেন।
রাজনীতিক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এই সব বৈশিষ্ট্যে ফিরতে হচ্ছে কেন? তিনি কি এই সব বৈশিষ্ট্য বিসর্জন দিয়েছিলেন? একেবারেই নয়, বিসর্জন তিনি মোটেই দেননি। কিন্তু বিরোধী নেত্রীর আসন থেকে প্রশাসকের আসনে পৌঁছে যাওয়ার পরে স্বাভাবিক কারণেই কিছুটা বদলাতে হয় কাজের ধরন। মমতা সম্ভবত সেইটুকুই বদলেছিলেন নিজেকে। কিন্তু সে বদলও বিসর্জন দিয়ে আপাতত যে পুরনো অবতারেই ফিরবেন, লোকসভার ফল ঘোষিত হওয়ার দু’দিন পরে কালীঘাটের সাংবাদিক সম্মেলনেই সে ইঙ্গিত দিয়ে দিয়েছিলেন। এ বার দলটা বেশি করে করব— বলেছিলেন মমতা। সে কথা যে কথার কথা ছিল না, তার প্রমাণ গত কয়েক দিন ধরে বেশ মিলতে শুরু করেছে।
পুলিশ এবং প্রশাসনে সাংঘাতিক নাড়া দিয়ে দিয়েছেন। গোটা রাজ্যে নিজের দলের সংগঠনকে ঢেলে সাজিয়েছেন। পর্যালোচনা বৈঠক, কোর কমিটির বৈঠক, একের পর এক জেলার সঙ্গে আলাদা করে বৈঠক, সত্যাগ্রহ, ধর্না, পদযাত্রা— পর পর কর্মসূচি নিয়ে দলকে ব্যস্ত রাখতে চাইছেন। বিজেপির উত্থানটা তৃণমূল কর্মীদের কাছে মানসিক ধাক্কা হয়ে উঠুক, এমনটা হতে দিতেই চাইছেন না। এ সবের মাঝেই হাজির করেছেন প্রশান্ত কিশোরকে। গোটা দল সেখানেই বার্তা পেয়ে গিয়েছে— বিজেপি-কে আটকে দেওয়ার দায়িত্বটা পুরোপুরি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন নেত্রী, কোনও হাতিয়ারই পড়ে থাকতে দিচ্ছেন না।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই রাজনীতিই সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা বিজেপির। ‘দিদি’কে কটাক্ষ বা আক্রমণ যতই করুন, ‘দিদি’র এই রাজনৈতিক কুশলতাকে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহও সমীহই করেন বলে শোনা যায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেও খুব ভাল ভাবেই জানেন নিজের ‘প্লাস পয়েন্ট’গুলো। অতএব সেই পথেই এগোতে শুরু করে দিয়েছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলের চেয়ারপার্সন। তৈরি করে দিয়েছেন একটা পুরোদস্তুর যুদ্ধ-যুদ্ধ পরিস্থিতি, যে পরিস্থিতিতে আর যা-ই হোক, নৈতিক ভাবে দমবেন না দলের কর্মীরা, থাকবেন চ্যালেঞ্জ নেওয়ার মেজাজে।
প্রশান্ত কিশোরকে নিয়ে কি এই প্রথম বার উৎসাহ দেখালেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? না, আগেও প্রশান্ত কিশোরের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল তাঁর দল। ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনের আগেও প্রশান্ত কিশোরের সঙ্গে বৈঠক হয়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। কিন্তু কথা খুব বেশি দূর এগিয়ে নিয়ে যাননি তৃণমূলনেত্রী। প্রশান্ত কিশোর অনেক টাকা চাইছেন বলেই তাঁর সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা সম্ভব হচ্ছে না, মমতা জানিয়েছিলেন ঘনিষ্ঠদের।
রাজনৈতিক শিবিরের মত অবশ্য অন্য রকম। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চাইলেও শুধুমাত্র টাকার অভাবে প্রশান্তের সঙ্গে তৃণমূলের চুক্তি আটকে যাবে, এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই বলেই পর্যবেক্ষকদের মত। আসলে প্রশান্তকে সে সময়ে অপরিহার্য মনে করেননি মমতা। অপরিহার্য সম্ভবত এ বারও মনে করছেন না তিনি। কিন্তু এখন তিনি এই বার্তাটাও নিজের দলকে দিতে চাইছেন যে, যুদ্ধটা এ বার এসপার নয় ওসপারের, তাই দলকে সম্ভাব্য সব রকম সুরক্ষা বেষ্টনীতে ঘিরে রাখার কোনও সুযোগ এ বার হাতের বাইরে রাখা হবে না। কর্মীদেরও অতএব ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে সবটা উজাড় করে, বুঝিয়ে দিচ্ছেন নেত্রী।