নেত্রীর ‘কাটমানি’মন্তব্য আচমকা গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে শোভনের। —ফাইল চিত্র।
কাটমানি প্রসঙ্গে বিস্ফোরণটা ঘটিয়েছিলেন ৩ জুন। লোকসভা নির্বাচনে দলের ফলাফল বিশ্লেষণের বৈঠকে বসে। ১৮ জুন নজরুল মঞ্চে দলীয় কাউন্সিলদের সভায় আরও স্পষ্ট করে ধমক দেন সেই একই প্রসঙ্গে। কাটমানি নিয়ে থাকলে ফেরত দিয়ে দিন— এমনও বলেন তৃণমূল চেয়ারপার্সন। কিন্তু সে ধমকে হিতে বিপরীত হওয়ার ইঙ্গিত। দলনেত্রীর ধমক গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে ইন্ধন জুগিয়ে দিয়েছে মালদহ, বীরভূম-সহ একাধিক জেলায়। চোরাস্রোত বইতে শুরু করেছে খাস কলকাতাতেও। নেত্রীর মন্তব্যে ফাঁপরে পড়ে কাউন্সিলরদের অনেকেই বিকল্প পথের সন্ধানে। গত দু’দিনে অনেকেই যোগাযোগ করেছেন প্রাক্তন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে।
দলের ভাবমূর্তি বা বিভিন্ন স্তরের জনপ্রতিনিধিদের ভাবমূর্তি কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে? এই প্রশ্ন এখন খুব বড় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল দেখার পরেই যে বিষয়টি নিয়ে বেশি করে ভাবতে শুরু করেছেন তিনি, তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে দিন পনেরোর ব্যবধানে হওয়া দুটো বৈঠকে। প্রথমে ফলাফল বিশ্লেষণের বৈঠক, তার পরে কাউন্সিলরদের সভা— পনেরো দিনের মধ্যে দু’বার কাটমানি নিয়ে দলীয় জনপ্রতিনিধিদের ধমক দিয়েছেন তিনি। ৩ জুনের বৈঠকে দিনহাটার বিধায়ক উদয়ন গুহর একটি কথার জবাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, জনসাধারণকে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের সুবিধা জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে দেওয়ার চেষ্টা হলেই কাটমানির রমরমা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। আর ১৮ জুন কাউন্সিলরদের উদ্দেশে তাঁর বিস্মিত প্রশ্ন— আবাসন প্রকল্প থেকে কেন ২৫ হাজার টাকা খেতে হবে? সমব্যাথী প্রকল্পের ২০০০ টাকা থেকে কেন ২০০ টাকা খেতে হবে? এই প্রশ্ন তুলেই থামেননি তৃণমূল চেয়ারপার্সন। যাঁরা কাটমানি নিয়েছেন, তাঁরা ফেরত দিয়ে দিন। দিয়েছেন এই রকম নিদানও।
রাজনৈতিক শিবিরের একটি অংশের ব্যাখ্যা, কাটমানি খাওয়ার প্রবণতার কথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এত দিন পরে জানতে পারলেন, এমন নয়। লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পরে দলের জনভিত্তি নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন। সেই কারণেই তিনি ড্যামেজ কন্ট্রোলের চেষ্টা করেছেন এবং সাধারণ নাগরিকের প্রাপ্যে দলীয় নেতা-কর্মীদের ভাগ বসানোর প্রবণতার বিরুদ্ধে প্রায় প্রকাশ্যে একটা বার্তা দিতে চেয়েছেন।
আরও পড়ুন: ভাটপাড়া স্বাভাবিক করতে ৭২ ঘণ্টা সময় দিলেন মুখ্যমন্ত্রী, দায়িত্বে নয়া পুলিশ কমিশনার
আরও পড়ুন: মৃত্যু বেড়ে ২, বোমা-গুলির লড়াইয়ে উত্তপ্ত ভাটপাড়া নিয়ে বৈঠক নবান্নে, পৌঁছলেন ডিজি
কিন্তু ড্যামেজটা কি আদৌ কন্ট্রোলে এল? সংশয় যথেষ্ট। নেত্রীর মন্তব্য অস্বস্তি বাড়িয়ে দিল বিভিন্ন স্তরের জনপ্রতিনিধিদের। মাস কয়েক আগেকার পরিস্থিতি বহাল থাকলেও জনপ্রতিনিধিরা মুখ বুজে সব মেনেই নিতেন। কিন্তু রাজ্যে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটে গিয়েছে মে মাসেই। তাই দাঁতে দাঁত চেপে অস্বস্তি সহ্য করেও দলকে আঁকড়ে থাকতে অনেকেই আর রাজি নন। ক্ষোভের সেই চোরাস্রোতটা সবচেয়ে বেশি বইতে শুরু করেছে কলকাতাতেই।
১৮ জুন নজরুল মঞ্চে নেত্রীর ধমক খাওয়ার পর থেকে কলকাতার এক ঝাঁক কাউন্সিলর, বরো চেয়ারম্যান, মেয়র পারিষদ যোগাযোগ করতে শুরু করেছেন প্রাক্তন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। আনুষ্ঠানিক ভাবে তৃণমূল এখনও ছাড়েননি শোভন। কিন্তু মন্ত্রিত্ব এবং মেয়র পদ ছাড়ার পর থেকে দলের কোনও কর্মসূচিতে তিনি অংশ নেননি। তার পরেও অবশ্য দলের কিছু দায়দায়িত্ব নীরবেই সামলে যেতেন শোভন। কিন্তু সম্প্রতি সে সবও তিনি বন্ধ করে দিয়েছেন। শোভন বিজেপিতে যেতে পারেন বলে এই ক’মাসে একাধিক বার গুঞ্জন তৈরি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে গত দু’দিনে শোভনের কাছে এক ঝাঁক কাউন্সিলরের ফোন ঢোকার অর্থ কী, তা বুঝতে রাজনৈতিক শিবিরের অসুবিধা হচ্ছে না।
কারা যোগাযোগ করেছেন শোভনের সঙ্গে? বেহালা এলাকার এক প্রভাবশালী কাউন্সিলর তথা মেয়র পারিষদ, দক্ষিণ কলকাতার এক বরো চেয়ারম্যান, পূর্ব কলকাতার এক বরো চেয়ারম্যান, মধ্য কলকাতার এক মেয়র পারিষদ। এ ছাড়া দক্ষিণ ও উত্তর কলকাতার আরও জনা দশেক কাউন্সিলর এবং উত্তর কলকাতার দীর্ঘ দিনের এক বিধায়কও গত দু’দিনে শোভনকে ফোন করেছেন বলে খবর।
কেন শোভনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন এই নেতারা? দলনেত্রীর কাটমানি মন্তব্যের পরে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাতে আগামী পুর নির্বাচনে তৃণমূলের ব্যানারে লড়া খুব শক্ত হয়ে পড়বে বলে এঁরা মনে করছেন। কারণ কাউন্সিলরদের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে নেত্রী নিজেই প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন। অন্য দিকে মাথাচাড়া দিচ্ছে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বও। কাটমানি সংক্রান্ত অভিযোগকে হাতিয়ার করে কাউন্সিলরদের বিরুদ্ধে রাতারাতি সক্রিয় হয়ে গিয়েছে তাঁদের বিরোধী গোষ্ঠীগুলি। এই পরিস্থিতিতে নেত্রীর খাড়া করা তত্ত্বকে চ্যালেঞ্জ করাই বিশ্বাসযোগ্যতা ধরে রাখার একমাত্র পথ— মনে করছেন অনেকেই। কিন্তু তৃণমূলে থেকে তা সম্ভব নয়। তাই বিকল্প ব্যানার খোঁজার চেষ্টা শুরু করে দিয়েছেন বেশ কিছু কাউন্সিলর, বরো চেয়ারম্যান বা মেয়র পারিষদ।
২০২০ সালে কলকাতা পুরসভার নির্বাচন। রাজ্যের বর্তমান রাজনৈতিক চিত্রটা যে রকম, তাতে তৃণমূলকে চ্যালেঞ্জ ছোড়ার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত মঞ্চ বিজেপি-ই। লোকসভা নির্বাচনে কলকাতার দুই আসনের একটাতেও বিজেপি জেতেনি। কিন্তু ৫০টা ওয়ার্ডে তারা তৃণমূলের চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বিজেপি আর একটু বাড়তে পারলেই পুরসভার লালবাড়ির রং গেরুয়া হয়ে যেতে পারে। প্রাক্তন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়কে দলে টানা গেলে সে লক্ষ্যে পৌঁছনো যে আরও সহজ হবে, তা বিজেপি নেতারা বেশ বুঝছেন। ফলে শোভনকে টানার চেষ্টাও তাঁরা চালিয়ে যাচ্ছেন। আর সেই যোগসূত্রের কথা কলকাতার কাউন্সিলরদের অনেকেরই অজানা নয়। অতএব আচমকা গুরুত্ব বাড়তে শুরু করেছে শোভনের। ১৮ জুনের পর বেড়ে গিয়েছে তাঁর সেলফোনের ব্যস্ততা।