পোস্ট অফিস চত্বরে খুলে রাখা হয়েছে তাপস পালের ফ্লেক্স। কৃষ্ণনগরে সুদীপ ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।
বিতর্কের পরে কলকাতায় পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু কৃষ্ণনগরে গিয়ে দলীয় সাংসদ তাপস পালকে পাশে রাখলেন না মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়!
মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসনিক বৈঠকে দলের বিধায়কেরা ছিলেন। ছিলেন রানাঘাটের সাংসদ তাপস মণ্ডলও। অথচ শুক্রবার নদিয়ার কৃষ্ণনগর রবীন্দ্র ভবনে সেই বৈঠকে দেখা গেল না কৃষ্ণনগরেরই সাংসদ তাপস পালকে। সাধারণত মমতা যা করেন, সেই রীতি ভেঙে বৈঠকের পরে তিনি ওই শহরে নয়, শান্তিপুরে গিয়ে জনসভা করলেন। এবং এক বারের জন্যও তাপসের নাম উচ্চারণ করলেন না!
রাস্তার ধার থেকে রাতারাতিই যেন কৃষ্ণনগরের সাংসদের মুখ সংবলিত ফ্লেক্সগুলো খুলে ফেলা হয়েছিল। নদিয়া ও মুর্শিদাবাদ মিলে ১৫৭টি প্রকল্পের উদ্বোধন ও ১৩০টি প্রকল্পের শিলান্যাস অনুষ্ঠানের সরকারি বিজ্ঞাপন থেকেও সযত্নে নাম বাদ বিতর্কিত সাংসদের!
প্রত্যাশিত ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, মুখে ক্ষমা করার কথা বললেও বা সংবাদমাধ্যমকে পাল্টা আক্রমণ করলেও ‘চন্দননগরের মাল’ বলে খ্যাত তাপসকে কি আসলে এড়িয়েই গেলেন তৃণমূল নেত্রী? তৃণমূল নেতৃত্ব এবং স্বয়ং তাপসের দাবি, সাংসদের শরীর খারাপ। তাই থাকতে পারেননি। যদিও বিরোধীরা এমন সহজ কারণ মানতে নারাজ। কুকথা বলে বিতর্কে জড়ানোর পরে দলনেত্রীর কাছে মাফ চেয়েই পার পেয়ে গিয়েছিলেন তাপস। তার পরে তাঁর বিরুদ্ধে কলকাতা হাইকোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে ডিভিশন বেঞ্চে মামলা লড়তে গিয়েছে রাজ্য সরকার। দলীয় সাংসদের কুকীর্তির দায় নিয়ে সরকারি খরচে কেন মামলা লড়া হবে, এই প্রশ্নে বিতর্ক আরও বেড়েছে। এর পরেও মনিরুল ইসলাম, অনুব্রত মণ্ডলদের মতো তাপসকেও মঞ্চে নিয়ে বসলে ফের বিতর্ক ও বিড়ম্বনা বাড়বে বুঝেই তাঁকে তৃণমূল নেত্রী এড়িয়ে গিয়েছেন বলে বিরোধীদের দাবি। তৃণমূলের অন্দরে একাংশের ব্যাখ্যাও তা-ই।
নদিয়ার নাকাশিপাড়া ও তেহট্টের কয়েকটি গ্রামে গিয়ে সম্প্রতি কুকথা ও হুমকির ঝড় বইয়ে দিয়েছিলেন তাপস। তার ভিডিও ফুটেজ সামনে আসতেই দেশ জুড়ে তোলপাড় হয়। চৌমুহা গ্রামে গিয়ে তাপসের ‘ঘরে ছেলে ঢুকিয়ে রেপ করে দেব’ নিয়ে বিতর্ক এখনও অব্যাহত। হাইকোর্টে মামলা চলার পাশাপাশি আদালতের বাইরেও রাজ্যবাসীর স্মৃতিতে গোটা বিষয়টি এখনও তাজা। বিশেষত, মহিলা মহলে প্রতিক্রিয়া তীব্র। চৌমুহা-সহ বিভিন্ন গ্রামের মহিলারা প্রকাশ্যে ক্ষোভও জানিয়েছেন। পরিস্থিতি বিচার করেই আর ‘ঝুঁকি’ নেননি তৃণমূল নেত্রী।
দলের জেলা স্তরের বৈঠকেও ইতিমধ্যে অনেক বিধায়ক তাপসের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন। এক জেলা নেতার দাবি, “জনপ্রতিনিধি ও নেতাদের ক্ষোভের কথা নেত্রীর কানে পৌঁছেছে। সাধারণ মানুষ, বিশেষত কৃষ্ণনগর বাসিন্দারা যে সাংসদের ওই মন্তব্যে ক্ষুব্ধ, তা-ও তিনি জানেন। তাই হয়তো এ বারের জেলা সফরে তাপস পালের পাশাপাশি কৃষ্ণনগর কেন্দ্রকেও এড়িয়ে গেলেন। তা না হলে তিনি শান্তিপুরে সভা করতে যাবেন কেন?’’
তাপস অবশ্য দাবি করেছেন, অসুস্থতার কারণে তিনি নিজেই সভা বা বৈঠকে যাননি। ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ্যে আসার পরেই কলকাতার একটি নার্সিংহোমে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। সংসদের অধিবেশনও এড়িয়ে চলছেন। তাপস এ দিন ফোনে বলেছেন, “আমি খুব অসুস্থ। ডাক্তার বিশ্রাম নিতে বলেছেন। তাই কোনও সভা-সমিতিতে যাচ্ছি না।” তৃণমূলের জেলা সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্তেরও দাবি, ‘‘তাপস পাল আসতে পারলে আমরা খুশিই হতাম। কারণ, মানুষ দু’হাত ভরে ভোট দিয়ে তাঁকে ফের নির্বাচিত করেছেন। কিন্তু তিনি অসুস্থ। চিকিৎসকের নির্দেশেই তিনি দলের কাছ থেকে ১৪ অগস্ট পর্যন্ত ছুটি নিয়েছেন।”
তাপসকে কি আদৌ আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল? গৌরীবাবুর বক্তব্য, “এটা সরকারি অনুষ্ঠান। তাই দলের তরফে নিমন্ত্রণ জানানোর প্রশ্ন ওঠে না।’’ প্রশাসনের তরফে নদিয়ার জেলাশাসক পি বি সালিম বলেন, ‘‘নিয়মমাফিক সাংসদ তাপস পালকে আমরা আমন্ত্রণ করেছিলাম। কিন্তু অসুস্থতার কারণে তিনি আসতে পারবেন না বলে জানিয়ে দেন।’’ তবে জেলা তৃণমূলেরই একাংশের দাবি, হাইকোর্টের চূড়ান্ত রায় না বেরোনো পর্যন্ত তিনি কোনও অনুষ্ঠানে হাজির হবেন না বলে দলে সিদ্ধান্ত হয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে এটাই শান্তিপুরে মমতার প্রথম জনসভা। এমনকী, কংগ্রেস বিধায়ক ও পুরপ্রধান অজয় দে যখন তৃণমূলে যোগ দিয়ে উপনির্বাচনে ‘সম্মানের লড়াই’ লড়তে নামেন, তখনও মমতা তাঁর হয়ে প্রচারে আসেননি। অথচ এখন তাপস-গুঁতোয় কৃষ্ণনগর লোকসভা এলাকা এড়িয়ে সেই শান্তিপুরকেই বেছে নিতে হল বলে কটাক্ষ করছেন কেউ কেউ! শান্তিপুরের সভাতেও আশানুরূপ উপচে-পড়া ভিড় চোখে পড়েনি। অজয়বাবু অবশ্য বলেন, ‘‘আমিই দলনেত্রীকে শান্তিপুরে সভা করার অনুরোধ করেছিলাম। ভোটের সময়ে ব্যস্ত ছিলেন। তখন বিরক্ত করিনি।’’
শাসক দলের নেতাদের একাংশই অবশ্য ঠারেঠোরে স্বীকার করছেন, কৃষ্ণনগরে যাতে দলনেত্রীর ‘পচা শামুকে’ পা না কাটে, তার জন্য সব রকম সতর্কতা নিতে হয়েছিল।
সেই কারণেই তাপসের হাসি-মুখ ফ্লেক্স রাতারাতি খুলে ফেলা হয়েছিল। গৌরীবাবু অবশ্য দাবি করেন, “কোনও ফ্লেক্স খোলা হয়েছে বলে আমার জানা নেই!”