রাজ্যের পুরসভাগুলির চেয়ারম্যানদের ক্ষমতা খর্ব করে এ বার আমলাদের উপরেই ভরসা করতে চলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। চলতি পুর আইন যে ভাবে সংশোধনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার, তাতে মূলত আর্থিক বিষয়গুলিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে চেয়ারম্যানদের প্রায় পদে পদেই মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে আমলাদের।
এত দিন পুরসভা পরিচালনায় চেয়ারম্যান ও তাঁর নেতৃত্বাধীন পরিষদের (সিআইসি) হাতে প্রায় সব বিষয়েই অবাধ ক্ষমতা ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় বার নবান্নে ফিরে কড়া হাতে প্রশাসনের রাশ ধরতে চাওয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ বার পুরসভার কাজকর্মেও প্রশাসনিক কর্তাদের এক্তিয়ার বাড়াতে চাইছেন।
বিধানসভার চলতি অধিবেশনেই ‘দ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল মিউনিসিপ্যাল (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল, ২০১৭’ পেশ করতে চলেছে পুর ও নগরোন্নয়ন দফতর। যে বিলে পরিষ্কারই বলা হয়েছে, শহরাঞ্চলে স্থানীয় প্রশাসনের (পুরসভা) মাধ্যমে এখন উন্নয়নের গতির সঙ্গে তাল রাখার জন্য প্রশাসনিক আধিকারিকদের (বিলের ভাষায় ‘এগ্জিকিউটিভ অফিসার’) বাড়তি অনেক দায়িত্ব নিতে হয়। রাজ্য সরকারের নানা প্রকল্প বাস্তবায়িত করতেও প্রশাসনের লোকজনের ভূমিকা বিশাল। স্থানীয় প্রশাসনের কাজ আরও মসৃণ করতে তাই প্রশাসনিক আধিকারিকদের ক্ষমতা বাড়ানো দরকার।
তবে বিলের পরিভাষার খোলস ছাড়ালে গোটা বিষয়ের মানে দাঁড়াচ্ছে— পুরসভার চেয়ারম্যানদের পায়ে এ বার বেড়ি পরাতে চাইছে সরকার! পঞ্চায়েত পরিচালনায় এখন যেমন বিডিও-দের ভূমিকা মুখ্য, পুরসভার ক্ষেত্রেও এখন প্রশাসনিক আধিকারিকেরাই বাড়তি গুরুত্ব পাবেন। সংশোধনী বিলের খসড়ার ছত্রে ছত্রে তাই চেয়ারম্যান শব্দের পরিবর্তে বা তার সঙ্গে ‘এগ্জিকিউটিভ অফিসার’ কথাটা জুড়ে দেওয়া হয়েছে। সরকারি সূত্রে বলা হচ্ছে, পুরসভায় বিশৃঙ্খলা কমিয়ে খরচ-সহ সব ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা বজায় রাখতেই এই পদক্ষেপ। যদিও বিরোধীদের অভিযোগ, নির্বাচিত সংস্থার ক্ষমতা খর্ব করে আমলাতন্ত্রের উপরে বেশি নির্ভরশীল হওয়াটা আরও একটি অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপ!
এমন বিলের খবরে মুষড়ে পড়েছে তৃণমূলের বড় অংশও। কারণ, রাজ্যের প্রায় সব পুরসভাই এখন তাদের হাতে! শাসক দলের এক চেয়ারম্যানের আক্ষেপ, ‘‘কষ্ট করে আমরা ভোটে জিতব। বিধানসভা বা লোকসভা ভোটে দলকে লিড দেব। তার পরে সিদ্ধান্ত সব নেবেন অফিসারেরা?’’ বিরোধীদের হাতে-থাকা যাবতীয় পুরসভাই সাম্প্রতিক কালে দখল নিয়েছে শাসক দল। যার মধ্যে অধীর চৌধুরীর খাস তালুক বহরমপুরও আছে। বহরমপুরের কংগ্রেস বিধায়ক মনোজ চক্রবর্তীর কটাক্ষ, ‘‘ভয় বা প্রলোভন দেখিয়ে সবই তো ওঁরা দখল করেছেন। তার পরেও নিজের দলের চেয়ারম্যানদের উপরে মুখ্যমন্ত্রীর ভরসা নেই!’’ রাজ্যের প্রাক্তন পুরমন্ত্রী এবং শিলিগুড়ির মেয়র অশোক ভট্টাচার্যের অভিযোগ, পঞ্চায়েতের পরে এ বার পুরসভাতেও আমলা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইছে সরকার। তাঁর কথায়, ‘‘সংবিধানের ৭৩ ও ৭৪ তম সংশোধনের পরে নির্বাচিত স্থানীয় সংস্থার গুরুত্ব সর্বত্র স্বীকৃত। কিন্তু এই সরকার উল্টো পথে হাঁটছে।’’
চেয়ারম্যানদের কিছু ক্ষমতাও অবশ্য সংশোধনী বিলে বাড়ানো হচ্ছে। যেমন, কোনও কাজে বা কিছু সামগ্রী কেনার জন্য চেয়ারম্যানের এক্তিয়ারে এখনকার আইন অনুযায়ী ২৫ হাজার টাকা খরচ করা যায়। নতুন বিলে তা বেড়ে এক লক্ষ হবে। চেয়ারম্যান পরিষদ এবং বোর্ডের অনুমোদন নিয়ে পুরসভা যত টাকা খরচ করতে পারে, তার অঙ্কও বাড়ছে। এখন কোনও পুরসভা ২৫ লক্ষের বেশি টাকা খরচ করতে গেলে সরকারের অনুমোদন লাগে। তা বেড়ে ৪৫ লক্ষ হচ্ছে। তবে কোনও প্রকল্পের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে আমলার।
এরই পাশাপাশি পুরসভাগুলির কাজের সুবিধার জন্যও কিছু পদক্ষেপ করছে রাজ্য। যেমন, পুরসভার কাজে বাধা দেওয়া হচ্ছে মনে করলে চেয়ারম্যান যে কোনও কাউকে গ্রেফতার করার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দিতে পারেন। বিরোধীদের মতে, এই পথে আসলে পুরসভায় বিক্ষোভ দমন করতে চাইছে সরকার।